[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

একটি ঘোড়া, এক জীবন-তিন হাজার কবর: মনু মিয়ার গল্প

প্রকাশঃ
অ+ অ-

এই ঘোড়ার পিঠে চড়ে কবর খোঁড়ার জন্য বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যেতেন মনু মিয়া |  ছবি: সংগৃহীত

ইটনার আলগাপাড়া গ্রামের আকাশ আজ হয়তো একটু বেশি নীল, কিংবা একটু বেশি ভারী। যে মানুষটি জীবনের অর্ধশত বছর কাটিয়েছেন অন্যদের চিরশয্যার ঘর বানিয়ে, আজ তাকেই শুইয়ে দেওয়া হলো মাটির বুকে।

মনু মিয়া আর নেই। কিশোরগঞ্জের ইটনার সেই  গোরখোদক, যিনি খুন্তি-কোদাল হাতে রাতের আঁধার ভেদ করে মানুষের শেষ আশ্রয়ের জন্য ছুটে যেতেন, আজ নিজেই চলে গেলেন অমোঘ পরিণতির পথে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

মনু মিয়া ছিলেন কবর খননের একজন গৌরবময় চরিত্র- তবে তাঁর কীর্তি কোনো বইয়ে লেখা নেই, কোনো স্মারকফলকে খোদাই করা হয়নি। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে, চোখের কোণে তাঁর জন্য জমে থাকা কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।

জীবনের ৫০ বছর ধরে ৩ হাজার ৫৭টি কবর খুঁড়েছেন বিনা পারিশ্রমিকে। দিনরাত, ঝড়বৃষ্টি, পিছুটান- কোনো কিছুই তাঁর পা আটকে রাখতে পারেনি। যখন কেউ মারা যেত, খবর পেলেই নিজের ঘোড়ায় চড়ে ছুটে যেতেন- কোনো ডাক, অনুরোধ কিংবা প্রতিদান না চেয়ে।

ঘোড়াটিও তাঁর সাধনার সঙ্গী ছিল। সেই ঘোড়া কিনতে বিক্রি করেছিলেন নিজের ধানি জমি। ভাবা যায়? যেখানে মানুষ জমি জমা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমায় জীবন কাটিয়ে দেয়, সেখানে মনু মিয়া তাঁর জীবনের লক্ষ্য পূরণে জমি বিসর্জন দিয়েছিলেন। কারণ তাঁর কাছে মানুষের শেষ বিদায়ই ছিল সবচেয়ে বড় ইবাদত।

কিন্তু তাঁর সেই একমাত্র ঘোড়াটি হত্যা হয় দুর্বৃত্তদের হাতে। পুরো দেশ কেঁদেছিল সেই খবরে। মিডিয়া প্রতিবেদন করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উত্তাল হয়। অনেকে সহযোগিতা দিতে চাইলেন, কেউ দিতে চাইলেন দামি ঘোড়া। কিন্তু মনু মিয়া গ্রহণ করেননি কিছুই। তিনি শুধু বলেছিলেন,'আমি সাহায্য চাই না, শুধু দোয়া চাই—আবার যেন কবর খুঁড়তে পারি।'

এই মানুষটি নিঃসন্তান ছিলেন, কিন্তু হাজারো মানুষের দোয়ার মালিক। হয়তো কোনো মৃত্যুশয্যায় কেউ বলেছিলেন, 'আমার কবরটা যেন মনু মিয়া খোঁড়ে'—এমন ভালোবাসা ক’জন অর্জন করতে পারে?

মনু মিয়ার ডায়েরি পাওয়া গেছে—যেখানে প্রতিটি মৃত ব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ, কবর খোঁড়ার সময় লেখা। কতটা দায়িত্ববোধ, কতটা মমতা থাকলে এমন নিখুঁত হিসেব রাখা যায়? যারা জীবনভর নিজের জন্মদিন মনে রাখে না, তাদের জন্য এই ডায়েরি এক জীবন্ত ইতিহাস।

তাঁর বিদায়ে শুধু একটি পরিবার নয়, শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে পুরো অঞ্চল। ইটনা, মিঠামইন, আজমিরীগঞ্জ, শাল্লা থেকে শুরু করে রাজধানীর বনানী পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে তাঁর হাতে খোঁড়া কবরের স্মৃতি। অথচ তিনি কোনোদিন টু শব্দ করেননি। চেয়েছেন শুধু মানুষকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় দিতে।

আজ যখন তাঁকে দাফন করা হচ্ছে, তখন হয়তো কোনো কিশোর তাঁর গল্প শুনে ভাবছে- মানুষ শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মহান হয় না; কেউ কেউ কবর খুঁড়ে হয়ে যান মহাপুরুষ।
মনু মিয়ার জীবনের মানে ছিল- 'মরণেও যেন মানবতা জাগে।'
এই জাগরণই তাঁকে অমর করেছে।

একটা কথা বারবার মনে পড়ছে আজ- কিছু মানুষ মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকেন, শুধু কবরের নিচে নন, মানুষের কৃতজ্ঞতায়। মনু মিয়া ঠিক তেমন একজন মানুষ।

আজ যখন সূর্যটা একটু ঝুঁকে পড়বে পশ্চিমে, আর আলগাপাড়ার মাটি স্পর্শ করে কেউ বলবে, 'আল্লাহ এই মানুষটিকে জান্নাত দান করুন'- তখনই বোঝা যাবে, মানুষ শুধু নিজের জন্য না, অন্যের জন্য বাঁচলেই সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকে।

আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা,
মনু মিয়ার কবরও হোক শান্তির, প্রশান্তির, সম্মানের।
আমিন।

● লেখক: সাংবাদিক  

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন