প্রতিনিধি কক্সবাজার
![]() |
কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নের বোমাংখিল গ্রামের ঘরের উঠানে শুকানো হচ্ছে তামাক পাতা । এরপর পোড়ানো হবে চুল্লিতে। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কক্সবাজার শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে রামুর দুর্গম গর্জনিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম বোমাংখিল গ্রাম। চলতি মৌসুমে গ্রামের অন্তত ৭০০ একর ফসলি জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে গ্রামে স্থাপন করা ৪৫টি চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানো শুরু হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেই এসব চুল্লির। বনাঞ্চলের কাঠ পুড়িয়ে এসব চুল্লিতে তামাক উৎপাদন করা হচ্ছে। কেবল তা–ই নয়, এসব তামাক উৎপাদনের চুল্লির ৭০ শতাংশ শ্রমিকই নারী ও শিশু।
গত সোমবার দুপুরে গর্জনিয়া ইউনিয়নের বোমাংখিল গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির আঙিনায় স্থাপন করা একটি চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানো হচ্ছে। বাড়িটি নুরুল ইসলাম নামের এক তামাকচাষির, চুল্লিটিও তাঁর। চুল্লির পাশে পড়ে আছে কাঠের স্তূপ। পাশের মাঠে রোদে শুকানো হচ্ছে তামাকপাতা। কয়েকজন শ্রমিক চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানোর কাজে ব্যস্ত। শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকটি শিশুও আছে। চুল্লির আরেক পাশে অবস্থিত তামাকখেতে তামাকপাতা কাটছিলেন দুজন নারী। আলাপ করতে চাইলে তাঁদের একজন বলেন, সকাল সাতটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত গাছ থেকে তামাকপাতা কাটতে হয়। মজুরি পাওয়া যায় ৫০০-৬০০ টাকা। তামাকের তাজা রস হাতে লাগলে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, চামড়া উঠে যায়। চর্মরোগ হয়, সব সময় চুলকাতে থাকে। এলাকায় আয়রোজগারের কাজ নেই বলে তামাকপাতা কাটতে হচ্ছে।
চুল্লির মালিক নুরুল আবছার (৪৫) ছয় বছর ধরে তামাক চাষ করছেন। আগে চুল্লিটি বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি ছিল, আগুনে পুড়ে চুল্লির বেড়া নষ্ট হয় বলে তিন মাস আগে ইট দিয়ে স্থায়ী চুলা তৈরি করেছেন। ১৫-২০ দিন ধরে এখানে তামাকপাতা পোড়ানো হচ্ছে। এই পাতা বিভিন্ন তামাক কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হবে।
কেবল বোমাংখিল নয়, গর্জনিয়া ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামেই এমন চুল্লি আছে। সব মিলিয়ে ৮০০টির বেশি বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবিষয়ক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান। বিষয়টি স্বীকার করেছে বন বিভাগও। বনকর্মীদের দেওয়া তথ্যমতে, রামুর গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, ঈদগড়, কাওয়ারখোপ, ফতেখাঁরকুল এবং পার্শ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর, সোনাইছড়ি দোছড়ি, বাইশারী ইউনিয়নে চুল্লি আছে তিন হাজারের বেশি। এর বাইরে কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, ঈদগাঁও ও উখিয়া উপজেলাতে চুল্লি আছে আরও অন্তত দুই হাজার। সর্বমোট পাঁচ হাজার চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানো হয় বনাঞ্চলের কাঠ দিয়ে। চলতি মৌসুমে এসব অঞ্চলে তামাকের চাষ হয়েছে ১২ হাজার একরের বেশি জমিতে।
![]() |
কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নে তামাকপাতা পোড়ানোর জন্য চুল্লিতে মজুত কাঠের স্তূপ। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
গর্জনিয়ার বোমাখেরবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিশুরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে তামাকচুল্লিতে কাজ করছে। সারা দিন কাজ করলে শিশুরা ৫০০ টাকা পায়। চাষি পরিবারের অধিকাংশ নারী-শিশু চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানো কাজ করছে, তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বনকর্মীদের মাসোয়ারা দিয়ে চুল্লিতে জ্বালানি কাঠ সরবরাহ ও মজুত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে রামুর এক বন রেঞ্জ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গর্জনিয়া, ঈদগড়, কচ্ছপিয়াসহ আশপাশের পাঁচটি ইউনিয়নের তামাকের চাষ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চুল্লিও। কিন্তু বন বিভাগের কাছে চুল্লি ও তামাক চাষের কোনো তথ্য নেই। বেশির ভাগ চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে সরকারি ভূমিতে এবং নদীর তীরে। চুল্লি থেকে নির্গত বিষাক্ত রসে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, কয়েক হাজার একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে, এটা সঠিক। কিন্তু খাস জমিতে চুল্লি স্থাপনের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তামাক চাষের জন্য বাঁকখালী নদীর চরভূমি কিংবা বনাঞ্চলের পরিত্যক্ত জমি কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি।
ধ্বংস হচ্ছে নদী-ছড়ার মাছ ও জীববৈচিত্র্য
কক্সবাজারের কত একর জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে, আর চুল্লি তৈরি হয়েছে কতটি, তার সঠিক পরিসংখ্যান উপজেলা প্রশাসন, বন, কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরে নেই। তবে জেলার পরিবেশকর্মীরা বলেন, চলতি মৌসুমে অন্তত ১২ হাজার একর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, তামাকপাতা পোড়ানোর জন্য তৈরি হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি চুল্লি। তামাক আগ্রাসন থেকে বনভূমি, নদীর তীর, বাড়ির আঙিনা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশেও তামাক চাষ হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে চুল্লিও। শতভাগ চুল্লিতে বনের কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। কোনো চুল্লিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেই।
দেখা গেছে, বেশ কিছু চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে নদী, ছড়া বা খালের তীরে। চুল্লি থেকে নির্গত তামাকের বিষাক্ত রস মাতামুহুরী, বাঁকখালীসহ চকরিয়া, সদর, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ১৫টির বেশি নদী-খাল ও ছড়ার পানিতে মিশছে। তাতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হলেও বন বিভাগ কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তর এ পর্যন্ত কোনো চুল্লিতে অভিযান চালায়নি।
![]() |
কক্সবাজারের চকরিয়ার বরইতলীর এই জমিতে এক সময় ফুলের চাষ হতো। এখন হচ্ছে তামাকের চাষ। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তোফাইল আহমদ বলেন, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির ৯টি ইউনিয়নে পাঁচ হাজার একরের বেশি জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। চুল্লি আছে তিন হাজারের মতো। তামাকের বিষাক্ত রস বাঁকখালী নদী, পাশের বড়জামছড়ি, গজইখাল, ছোট জামছড়ি খাল, দোছড়িখালসহ ১০-১২টি ছড়ার পানিতে মিশে মাছ মরে যাচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। আগে নদী ও খালের পানিতে পুঁটি, ট্যাংরা, কই, চিংড়ি, বোয়াল, শিং, টাকি, পুঁইয়া মাছ ধরে সংসার চালাতেন দুই হাজার মানুষ। মাছ বিলুপ্ত হওয়ায় মানুষগুলো বেকার হয়ে পড়েছেন। নদীর তীরের সরকারি জমিতে তামাকের পরিবর্তে বেকার কৃষকদের ধান, আখ, ভুট্টা, লেবু, সবজি চাষের সুযোগ করে দেওয়া গেলে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। বনাঞ্চল ও পরিবেশ—উভয়ই রক্ষা পেত। চুল্লিতে তামাক পোড়ানো বন্ধ না হওয়ায় ৭০ শতাংশ নারী–শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।
তামাকচুল্লিতে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকেরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দূষণের শিকার হচ্ছে চুল্লির আশপাশের বাসিন্দারাও। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও শিশুরোগবিশেষজ্ঞ নুরুল আলম বলেন, চুল্লি থেকে নির্গত তামাকের ধোঁয়া থেকে শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, আলসার, হাঁপানিসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ে নারী-শিশুরা হাসপাতালে আসছে।
তামাকবিরোধী বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) কক্সবাজার আঞ্চলিক সমন্বয়ক মো. জয়নাল আবেদীন খান বলেন, তামাক চাষের কারণে একদিকে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে চাষিদের পরিবারের সদস্যসহ আশপাশের বহু মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তা ছাড়া চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়াতে গিয়ে প্রতিবছর শতকোটি টাকার কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। বেশির ভাগ কাঠ সংগ্রহ করা হয় বনাঞ্চল থেকে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. জমির উদ্দিন বলেন, তামাক চাষের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের করার কিছু থাকে না। তবে চুল্লি থেকে নির্গত তামাকের বিষাক্ত রসে মাছসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস কিংবা বিষাক্ত ধোঁয়ায় মানুষের স্বাস্থ্যহানির কিছু ঘটলে সে ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। রামু-চকরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজারো চুল্লি স্থাপনের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত কেউ পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেনি। ইটভাটার মতো তামাকচুল্লির বিপরীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা গেলে তামাক চাষ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা যেত।