{getBlock} $results={3} $label={ছবি} $type={headermagazine}

আমাদের সেকালের ঈদ

প্রকাশঃ
অ+ অ-

জহুরুল হক বুলবুল

ঈদে বাড়ি যাওয়া | ফাইল ছবি

স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে লৌহজং নদী। গ্রামে আছে প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল ও পোস্ট অফিস, আছে বড় খেলার মাঠ ও ঈদগাহ মাঠ। সে সময় গ্রামে হেঁটে চলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। পণ্য পরিবহনের জন্য ঘোড়া ও নদীপথে ছিল নৌকার ব্যবহার। রাস্তার ধারেই ছিল আমাদের বাড়ি। গ্রামের দুই দিকে প্রায় দুই কিলোমিটার মধ্যে ছিল দুটি হাট। একেকটা হাট বসত সপ্তাহে দুই দিন। রমজান মাসে ইফতারের সময় আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে হাট করে হাটুরেরা বাড়ি ফিরতেন। ইফতারের সময় হলে তাঁদের ইফতার করার মতো আর কোনো উপায় ছিল না। আমার দায়িত্ব ছিল তাঁদের ইফতার করানো। এক জগ পানি আর মুড়ি দিয়ে তাঁদের আপ্যায়ন করা হতো। এ খেয়েই তাঁরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন আর মাথায় হাত বুলিয়ে করতেন দোয়া।

বেশির ভাগ গ্রামেই দু-একটা বাড়িতেই ছিল ঘড়ি। রাতের আকাশের ‘সাত ভাই চম্পা’ (প্লেইয়াডিস তারকাগুচ্ছ) এতে সাতটি উজ্জ্বল তারা দেখা যায় এবং ‘আদম সুরুত’ (ওরিয়নস বেল্ট) এতে তিনটি উজ্জ্বল তারা এক লাইনে দেখা যায়। এ তারকাগুলো দেখেই গ্রামের নারীরা সাহ্‌রির সময় নিরূপণ করতেন।

ঈদে সামান্য একটা উপহারের বেশি পাবার সৌভাগ্য প্রায় কারোরই ছিল না। ইংলিশ প্যান্ট, না হয় শার্ট অথবা এক জোড়া স্যান্ডেল। এতেই আমাদের মধ্যে ছিল রাজ্যের খুশি। ঈদের আগের দিন কাপড় আয়রন করার জন্য আশপাশের কয়েক গ্রাম খুঁজে ও সিরিয়াল দিয়ে আনতাম কয়লার আয়রন। অনেকটা কায়দা করে ব্যবহার করতে হতো এই জিনিস। চুলা থেকে কয়লার ব্যবস্থা করতাম। তারপর এর ভেতরের বাক্সে কয়লা ভরে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে আগুন জ্বালিয়ে ইস্ত্রি উত্তপ্ত করা হতো। আমাদের জন্য মূল্যবান এই জিনিস, আবার আমরা ভালোমতে পারতাম না তা ব্যবহার করতে। পেছনে পেছনে ছুটতাম একটু বড়দের; বা যাঁরা এই কাজে পারদর্শী।

একটু বড় হওয়ার পর যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই নিজ জেলার বাইরে পাবনা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল (বর্তমানে পাবনা ক্যাডেট কলেজ) পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও রোজার ঈদের ছুটিতেও যখন বাড়িতে আসতাম, তখন বিভিন্ন বন্ধুও তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা চাকরি থেকে ছুটিতে আসত। সবাই মিলে ২৯ রমজান ইফতার করতাম স্কুলমাঠে। এ আয়োজনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন আমাদের অগ্রজ দুলাল ভাই। আমরা চাঁদা তুলে তাঁর কাছে দিলে তিনি নিজ হাতে ছোলা ও পেঁয়াজুসহ সব তৈরি করতেন। সঙ্গে আনতেন বাড়ি থেকে নিজ হাতে ভাজা মুড়ি। আমাদের সঙ্গে ইফতারে যুক্ত হতেন বহু পথচারী। সে সময় খেজুর, বেগুনি, জিলাপি কিংবা অন্য কিছুর কথা চিন্তা করাও ছিল একধরনের বিলাসিতা।

ইফতারের পর চলত পশ্চিম আকাশে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার প্রচেষ্টা। দেখতে না পারলে বাড়িতে গিয়ে রেডিও নিয়ে বসে পড়তাম চাঁদ ওঠার খবরের জন্য। সে সময় রেডিওতে সৈনিক ভাইদের জন্য প্রচারিত ‘দুর্বার’ অনুষ্ঠান এখনো কানে বাজেÑযার উপস্থাপনায় ছিলেন হাবিবুর রহমান জালাল। অনুষ্ঠানের মধে তিনি হঠাৎ বলে উঠতেন—একটি বিশেষ ঘোষণা...। শোনামাত্র আমরা বুঝে যেতাম ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। তারপর ঘোষণা আসতÑশাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে, আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঠিক তারপরই বাজত নজরুলের সেই বিখ্যাত গান; যা ছাড়া ঈদ অপূর্ণই থেকে যায় ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ যে গানের মাধ্যমে আমরা ঈদের আনন্দের জোয়ারে ভেসে যেতাম।

পরদিন সকালে বহুল প্রতীক্ষিত ঈদের নামাজ। সারা রাত সে কী আনন্দ–উত্তেজনা নিয়ে ছিল আমাদের অপেক্ষা। বলা বাহুল্য, আমাদের গ্রামের ঈদগাহ মাঠে ঐতিহাসিকভাবে বড় জামাত হয় এবং আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ একত্র হতেন নামাজ পড়ার জন্য। নামাজের পর বন্ধুরা মিলে ঠিক করতাম বিকেলে মাঠে কী খেলা হবে এবং কাদের সঙ্গে কারা খেলবে। এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ কিংবা থাকত হা-ডু-ডু খেলা। এসব খেলা উপভোগ করার জন্য মাঠের দুউ পাশে থাকত সব শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের মানুষের উপচে পড়া ভিড়। খেলা শেষে একরাশ আনন্দ আর বিনোদন নিয়ে সবাই নিজ নিজ বাড়ি ফিরতেন।

কালের বিবর্তনে আমাদের সেই ঈদ আনন্দ উদ্‌যাপনের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক বিনোদন অনুষ্ঠান আমরা পাচ্ছি স্মার্টফোন কিংবা টিভির স্ক্রিনে। শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যম ডাকযোগে পাওয়া ঈদকার্ডের পরিবর্তে এখন ফোনের ইনবক্স ভরে যায় অসংখ্য খুদে বার্তায়। আনন্দ দেয় এসব কিছু; কিন্তু আজও বেশি তাড়া করে ফেরে বারবার আমাদের সেই সেকালের ঈদ আয়োজন, যেখানে শুধু অনলাইনে নয়, সবার সরব উপস্থিতিতেও ছিল অনাবিল আনন্দ।

● লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কালিহাতী শাজাহান সিরাজ কলেজ, টাঙ্গাইল

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন