পিটিয়ে তরুণ হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে লাশ নিয়ে বিক্ষোভ, ৩০ ঘণ্টা পরও মামলা হয়নি
প্রতিনিধি বগুড়া: বগুড়ায় আত্মসমর্পণ করতে আসা এক তরুণকে আদালত ফটক থেকে উঠিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী। লাশ নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত দুই দফায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বগুড়া সদরের মানিকচক এলাকায় রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের বগুড়ার দ্বিতীয় বাইপাস সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা।
হত্যাকাণ্ডের ৩০ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। রোহান চৌধুরীর লাশ বাড়িতে পৌঁছানোর পর হামলার আশঙ্কায় স্থানীয় কৃষক লীগের নেতা গিয়াস উদ্দিন ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা লুৎফর রহমানের বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। স্বজনদের অভিযোগ, এ দুজনের নেতৃত্বেই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
নিহত ব্যক্তির নাম রোহান চৌধুরী (২২)। থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, মারপিটের একটি মামলায় গতকাল বুধবার সকাল ১০টার দিকে বগুড়া আদালতে আত্মসমর্পণ করতে যান রোহান। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের ফটক থেকে রোহান চৌধুরীকে উঠিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এরপর তাঁকে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ রাজাপুর ইউনিয়নের জয়বাংলা মোড়–সংলগ্ন জোড়গাছা হাটে জনাকীর্ণ স্থানে ফেলে যাওয়া হয়।
রোহান বগুড়া সদরের মানিকচক গ্রামের কামাল চৌধুরীর ছেলে। এ ঘটনায় রোহানের সঙ্গে থাকা সেলিম হোসেন (২২) নামের এক যুবককেও পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। সেলিম বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোহান চৌধুরী হত্যার পর থেকেই সদর উপজেলার দ্বিতীয় বাইপাস সড়কে মানিকচক এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। মানিকচক বন্দর এবং জয়বাংলা হাট এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিক্ষুব্ধ লোকজন মানিকচক এলাকায় প্রথম দফায় প্রায় আধঘণ্টা সড়ক অবরোধ করেন। এরপর শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বাড়িতে নেওয়ার সময় আরেক দফা সড়ক অবরোধ করেন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।
বিক্ষোভকারী ও নিহত ব্যক্তির স্বজনদের অভিযোগ, বগুড়া সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি এবং সাবেক ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিন ওরফে গিয়াস মেম্বারের নেতৃত্বে রোহান চৌধুরীকে আদালতের ফটক থেকে একটি অটোরিকশায় উঠিয়ে নেওয়া হয়। এরপর তাঁর ভাগনে বগুড়া পৌরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও বগুড়া সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফর রহমান তাঁর সহযোগীদের নিয়ে রোহানকে পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই গিয়াসউদ্দিন এবং লুৎফর রহমানের পরিবারে আত্মগোপন করেছেন। তাঁরা দ্রুত এ দুজনকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
লাশ নিয়ে বিক্ষোভের সময় রোহান চৌধুরীর চাচা ফারুক চৌধুরী, স্বজন রওশন চৌধুরী, বড় ভাই রবিউল চৌধুরী ও বড় বোন কামরুন্নাহার বেগম বক্তব্য দেন। বেলা আড়াইটার দিকে পুলিশের হস্তক্ষেপে মহাসড়ক থেকে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শাহিনুজ্জামান বলেন, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে রোহান চৌধুরীর লাশ বাড়িতে নেওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন কিছু সময় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। সন্ধ্যায় লাশ দাফনের পর থানায় মামলা দায়ের করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এদিকে রোহানের লাশ মানিকচক গ্রামে পৌঁছালে স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বড় বোন কামরুন্নাহার বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার নির্দোষ ভাইটা জিঘাংসার বলি হয়েছে। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়। আইনের প্রতি সম্মান জানাতে আদালতে জামিন নিতে যায়। আদালত ন্যায়বিচারের জায়গা, নিরাপদ জায়গা। সেখান থেকে খুনিরা আমার ভাইকে প্রকাশ্য তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করল। আদালত চত্বরে, শহরে কি কোনো পুলিশ ছিল না?’
পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে বগুড়া সদর উপজেলার কুটুরবাড়ি দক্ষিণপাড়ার সেলিম মিঞার ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এ সময় তাঁর হাত-পায়ের রগ কাটারও চেষ্টা করা হয়। সেলিম মিঞা কুটুরবাড়ি দক্ষিণপাড়ার সাবেক ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। তিনিও বর্তমানে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ হামলার ঘটনায় তাঁর বাবা গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় হত্যার প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলে ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলাতেই আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন রোহান।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ঘটনা
আদালত ভবনের ফটক থেকে রোহান চৌধুরীকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন সেলিম হোসেন। তিনি গতকাল বুধবার বলেন, সেলিম মিঞাকে মারপিটের ওই মামলায় ২ নম্বর আসামি ছিল রোহান চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে তিনি ও রকি নামের আরেক আসামি ইজিবাইকে করে আদালতে পৌঁছান। আদালত ফটকে পৌঁছার পর ওত পেতে থাকা গিয়াস উদ্দিনসহ তাঁর লোকজন জোরজবরদস্তি করে একটি অটোরিকশায় রোহান এবং তাঁকে উঠিয়ে নেন। এরপর তাঁদের হাতুড়ি, রড ও লাঠি দিয়ে মারধর শুরু করেন। এ সময় চিৎকার করলেও রাস্তার কেউ এগিয়ে আসেননি।
প্রথমে তাঁদের রাজাপুর ইউনিয়নের মন্ডলধরন গ্রামের পূর্বপাড়া কাজলের বাগানে নিয়ে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে ফেলা হয়। এরপর গিয়াসসহ তাঁর দুই ছেলে মিঠুন ও সাগর হাতুড়ি ও রড দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে তাঁদের মারধর করতে থাকেন। প্রায় এক ঘণ্টা বেধড়ক মারধরের একপর্যায়ে রোহান অচেতন হয়ে পড়েন। পরে আবারও অটোরিকশায় উঠিয়ে তাঁদের জয়বাংলা হাটে ফেলে রেখে যান। পরে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে মেহেদী হাসান নামের এক যুবকের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। গিয়াসউদ্দিনের ছেলে সেলিম মিঞা বিজিবির সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন। এক বছর আগে দিনাজপুরে ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তারের পর চাকরিচ্যুত হয়ে কিছুদিন হাজতে ছিলেন। জামিনে বেরিয়ে সেলিম মিঞা গ্রামে এসে বাবার সঙ্গে বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করেন। বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মেহেদী হাসানের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। কিছুদিন আগে জয়বাংলা হাটে একটি নির্মাণাধীন মার্কেটে বালু সরবরাহ নিয়ে মেহেদীর অনুসারীদের মারধর করেন সেলিম মিঞার অনুসারীরা। সে বিরোধের জেরে ২০ সেপ্টেম্বর রাতে মেহেদীর নেতৃত্বে সেলিম মিঞার ওপর হামলা হয়। সেই হামলার জেরে সেলিমের বাবা গিয়াস উদ্দিনের এ ঘটনা ঘটান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন