ফারদিন ফেরদৌস
![]() |
এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রে দেরিতে পৌঁছানোয় পরীক্ষা দিতে না পারায় ছাত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েন | ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া |
সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও চোখে পড়ল। এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী, পরীক্ষাকেন্দ্রের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে। চোখে জল, মুখে হতাশা, ভেঙে পড়া কণ্ঠে শুধুই মিনতি -কেন্দ্রে ঢুকতে দিতে অনুরোধ। কিন্তু না, তার আবেদন কোনো কাজে এল না। কোনো সহানুভূতি, মানবিকতা, ব্যতিক্রম -কিছুই কাজ করল না।
জানা গেল, মেয়েটির বাবা নেই। মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সকালে। বাড়িতে আর কেউ না থাকায় মেয়েটিকেই মাকে হাসপাতালে নিতে হয়। ওষুধ, ভর্তি, জরুরি সেবা -সব সামলে যখন কেন্দ্রে আসে, তখন পরীক্ষার নির্ধারিত সময় কিছুটা পেরিয়ে গেছে। আর সেখানেই শেষ।
রাষ্ট্রের কাণ্ডারিরা তখন নিয়মানুবর্তিতার গাঁথুনি আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। সময়মতো না আসায় তাকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হলো না। যেন রাষ্ট্র কোনো রোবট পরিচালিত ব্যবস্থা। যেন তার মানবিকতার সব রক্তনালীতে কঠিন বরফ জমে গেছে অনেক আগেই। একটা মেয়ে, যাকে সকালে মায়ের অসুস্থতা সামলাতে হয়েছে, হাসপাতালের বিছানায় মা রেখে, দৌড়ে এসেছে পরীক্ষা দিতে -সে কি ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করেছে? এই প্রশ্নগুলো পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ভাবলেন না। ভাবল না শিক্ষা বোর্ড। ভাবল না সেই কাঠামোগত রাষ্ট্রযন্ত্র।
এই রাষ্ট্র চলৎশক্তিহীন বা প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রাখে -সহায়ক রাখে, অতিরিক্ত সময় দেয়। অথচ একটি মেয়ের জীবনের এমন অনাহূত বিপদের দিনে তার জন্য কোনো ব্যতিক্রম রাখে না!
রাষ্ট্র কী তবে কেবল নিয়মপন্থী এক অমানবিক প্রাচীন যন্ত্রবিশেষ? যার কাছে মানুষের চোখের জল, মায়ের হাসপাতাল, পরীক্ষার্থীর আর্তনাদ -এসবের কোনো দাম নেই?
একটা মেয়ে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার দিনে, হঠাৎ বিপদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, এবং তার দায় কি রাষ্ট্র নিতে পারত না? আজ মেয়েটি পরীক্ষায় বসতে পারল না। তার একটি বছর নষ্ট হয়ে গেল। হয়তো এই একটি বছরই ছিল তার ভবিষ্যতের গতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ।
রাষ্ট্র যদি চাইতো, ১০ মিনিট দেরিতে আসা সেই মেয়েকে ১০ মিনিট সময়ও বাড়িয়ে দিতে পারতো। অন্তত তার পরীক্ষা নেওয়া যেত। সে যতটুকু পারতো, লিখে আসতো। কিন্তু রাষ্ট্র সে মানবিকতা দেখালো না।
রাষ্ট্র, তুমি কি জানো, কিছু নিয়ম ভাঙলে তাতে আইন মুষড়ে পড়েনা, বরং মানবতা আর বোধটাই জাগে। রে রাষ্ট্রযন্ত্র! তুমি যদি সদাশয় ও সহৃদয় হও আমাদের সভ্যতা তাতে প্রাণ পায়। হে দেশ! তুমি যদি তোমার একটা সন্তানের চোখের অশ্রুও মুছে দাও তবে মহাপ্রকৃতির মুখে বিরাট হাসি ফুটে।
● লেখক: সাংবাদিক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)