প্রতিনিধি ফরিদপুর
![]() |
লিচুর ফলন আশানুরূপ না হলেও উৎসাহ নিয়ে লিচুর আঁটি বাঁধছেন চাষি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ফরিদপুরের মধুখালীর জাহাপুরের লিচু রসালো ও সুস্বাদু। এ ছাড়া আবহাওয়াগত কারণে এখানকার লিচু পাকে দেশের অন্য এলাকার আগেই। এর ফলে মৌসুমের শুরুতেই জাহাপুরের লিচুর কদর বাড়ে। এই লিচুর বৈশিষ্ট্য—রং ও মান ভালো, খেতে সুস্বাদু, দামও সহনীয়। জাহাপুর ইউনিয়নের জাহাপুর, দপ্তরদিয়া, টেংরাকান্দি, মনোহরদিয়া, চর মনোহরদিয়া, খাড়াকান্দি ও মির্জাকান্দি গ্রামে লিচুর আবাদ বেশি।
তবে চলতি বছর খরার কারণে লিচুর ফলন আশানুরূপ হয়নি। আকারে ছোট, মিষ্টিও কম। গরমে ফেটে পড়ায় উৎপাদন কমেছে। তবুও এলাকায় লিচু নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার ঘাটতি নেই। জাহাপুর গ্রামে ১০৪ শতাংশ জমিতে লিচুবাগান করেছেন ওয়াদুদ মাতুব্বর (৫৫)। তিনি অন্তত ৩০ বছর ধরে লিচুবাগান করছেন। ১১ মে সরেজমিনে দেখা যায়, স্ত্রী আসমা বেগম (৪৫), ছেলেমেয়ে ও প্রতিবেশীরা বাগানে বসে লিচুর আঁটি বাঁধছেন। এমনকি পাশের সালথা উপজেলার আটঘর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে জামাতা জাহিদ খানও (৩৮) এসেছেন।
জামাতা জাহিদ খান বলেন, ১০ বছর ধরে তিনি লিচু ভাঙার সময় শ্বশুরবাড়িতে আসেন। আঁটি বাঁধা তাঁর কাছে কষ্ট নয়, বরং উৎসবের মতো।
ওয়াদুদ মাতুব্বর জানান, এ বছর লিচুর ফলন ভালো হয়নি। অন্যবারের থেকে ফলন তিন ভাগের এক ভাগ কমে গেছে। লিচু আকারে ছোট হয়েছে, মিষ্টিও তেমন হয়নি। তাঁর স্ত্রী আসমা বেগম বলেন, অনেকে মনে করেন, লিচু উৎপাদনে কোনো খাটনি নেই, সহজ কাম। কিন্তু লিচুর মুকুল আসার পর থেকে লিচু নামানোর আগপর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশক, কীটনাশক, ছত্রাক দূর করতে অন্তত এ জমিতে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। খরার জন্য লিচুর ফলন ভালো হয়নি। মাঘ মাসের শেষের দিকে বৃষ্টি হলে এত খারাপ অবস্থা হতো না। ওই সময় লিচুর জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এক ফোটা বৃষ্টিও হয়নি।
পাইকারি বিক্রেতা দোহার এলাকার মো. হাশেম (৪২) জানান, জাহাপুরের লিচু আগে পাকে। এ জন্য এর কদর মৌসুমের শুরুতে বেশি। ঢাকা, বরিশাল, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ আশপাশের জেলায় যায়।
![]() |
শ্রমিক খরচ বেশি, তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎসবের মতো কাজ করছেন লিচুচাষিরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জাহাপুরের প্রবীণ লিচুচাষি আবদুস সাত্তার শেখ (৭৮) বলেন, প্রায় ৩০০ বছর আগে মাদ্রাজ থেকে আনা গাছ দিয়ে জমিদারেরা লিচুর বাগান শুরু করেন। জমিদারি উঠে যাওয়ার পর তিনি ৫৭ বছর আগে সেই গাছ কিনে বাগান শুরু করেন। এখনো সেই পুরোনো মোজাফফরপুরী গাছ আছে। পরের গাছগুলোও তার কলম।
আশরাফ আহমেদের বাগানে ৭০টি গাছ রয়েছে। তিনি বলেন, ফলন কম। কিন্তু এখন শ্রমিকের খরচ বেশি, তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎসবের মতো কাজ করছেন তাঁরা।
এই এলাকার অনেকেই এখন অন্যান্য ফসল ছেড়ে লিচু চাষে ঝুঁকছেন। লিচুগাছ নেই, এমন একটি বাড়িও যেন খুঁজে পাওয়া যাবে না ওই এলাকায়। বাড়িতে এক শতক বাড়তি জমি থাকলেই সেখানে রোপণ করা হয়েছে লিচুগাছ। বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে প্রায় ৫০ বছর ধরে, তবে গত ১৬ থেকে ২০ বছরে আবাদ বেড়েছে। প্রথমে মোজাফফরপুরী জাতের চাষ হলেও এখন বোম্বাই, চায়না থ্রি, বেদানা ও ভেরি জাতের লিচুও উৎপাদন হচ্ছে। মোজাফফরপুরী আগে পাকে, বোম্বাই ১০-১৫ দিন পরে। চায়না জাতের ওপর চাষিদের ভরসা কম।
জাহাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের উৎপাদিত লিচু আমাদের ঐতিহ্য। তবে এবার তীব্র খরা এবং আবহাওয়া ভালো না থাকায় লিচুর ফলন তেমন ভালো হয়নি। টানা খরার কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছেন চাষিরা। তাপে লিচুর গায়ে দাগ পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পরিপক্ব হওয়ার আগেই তা ঝরে পড়ছে। এ ছাড়া ফলও বড় হচ্ছে না। এতে ফলনবিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন চাষিরা।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শাহাদুজ্জামান বলেন, ‘খরার কারণে চলতি বছর লিচুর আকার ছোট হয়েছে। তবে আমরা উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছি (এক হাজার ২১৫ মে. টন), তাতে কোনো হেরফের হবে না। ফরিদপুরের লিচুচাষিরা চলতি বছর লিচু থেকে ৪০ কোটি টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশা করছি।’