নিজস্ব প্রতিবেদক
পাঁচ সমমনা ইসলামি দলের বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং করেন ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। বুধবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ইসলামপন্থীদের ভোট ‘এক বাক্সে’ আনার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন চরমোনাইয়ের পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। তাঁর এই উদ্যোগে গতকাল বুধবার শামিল হলো আরও চারটি নিবন্ধিত ইসলামি দল। সে দলগুলো হলো বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফত মজলিস। এর আগে বরিশালে চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর আমিরও ইসলামপন্থীদের ভোট ‘এক বাক্সে’ আনার উদ্যোগে একমত হয়েছিলেন।
আপাতত পাঁচটি নিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক দল একক প্রার্থী দিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন করার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে একমত হলো। এ উদ্যোগে জামায়াতে ইসলামী বা আরও কোনো দল যুক্ত হবে কি না, সেটি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
গতকাল রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ইসলামি দলগুলোর বৈঠকে চলমান সংস্কার কার্যক্রম, আগামী জাতীয় নির্বাচনসহ সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। বিশেষ করে, নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের আসনভিত্তিক একক প্রার্থী দেওয়া এবং ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের দেওয়া বিতর্কিত সুপারিশ সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণের বিষয়টি বৈঠকে আলোচনায় প্রাধান্য পায়।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইসলামী আন্দোলনের আমন্ত্রণে গতকাল সমমনা চারটি ইসলামি দল বৈঠকে বসে। ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’ নামে ছয়–দলীয় একটি জোট আছে। এ চারটি দল সে জোটের শরিক। যদিও এ বৈঠকে ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’ জোটের শরিক দুটি দল বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (একাংশ) ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনকে ডাকা হয়নি। কারণ, খেলাফত আন্দোলন জোটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আর বাংলাদেশ মুসলিম লীগ এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রায় ৩৫ বছর পর পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি দল আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে একসঙ্গে বসল। এর আগে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ নামে ইসলামি দলগুলোর একটি জোট হয়। সেখানে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের খেলাফত মজলিস, চরমোনাইয়ের পীর ফজলুল করীমের ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল ছিল। প্রথমে এই জোট থেকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং অনেক পরে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক বেরিয়ে যান। পরে শায়খুল হাদিস বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নামে দল প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর তাঁরই শিষ্য মুফতি ফজলুল হক আমিনী ‘বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট’ নামে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নেন।
এখন এত বছর পর আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে পাঁচটি দলের একমত হওয়ার চেষ্টাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন অনেকে। তবে এই প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী থাকবে কি না বা তাদের রাখা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের বৈরিতা বর্তমানে অনেকটা কমে গেছে। আবার ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মধ্যেও খুব সখ্য ছিল না। এখন দুই দল কাছাকাছি এসেছে।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের (ইসলামি দলগুলোর) কাছাকাছি আসার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে জনগণের প্রত্যাশাও আছে। আমাদের চেষ্টা থাকবে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনটা যাতে করতে পারি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো বড় দলগুলোর প্রলোভন। তাদের কারণে ছোট দলগুলো বিকাশ হতে পারে না। এখন আমরা যদি নীতির ওপর অটল থাকতে পারি, তাহলে সুযোগ আছে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার।’
কথা বলে জানা গেছে, ইসলামি দল ছাড়াও আরও কিছু দলের ভোটও ‘এক বাক্সে’ আনার চেষ্টা রয়েছে ইসলামী আন্দোলনের। এ লক্ষ্যে গতকাল নুরুল হকের গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গেও তারা বৈঠক করেছে। আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে শিগগিরই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। গতকাল পাঁচ দলের বৈঠকে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। পাঁচটি দল থেকে দুজন করে মোট ১০ সদস্যের লিয়াজোঁ কমিটি করা হবে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ‘আমরা পাঁচটি দল একসঙ্গে বসেছি। আগামী নির্বাচনে একসঙ্গে পথচলা যায় কি না, সেই কনসেপ্ট ধারণ করে আমরা বসেছি। পরবর্তী বৈঠকে যার যার চাহিদাপত্র নিয়ে আমরা আবার বসব।’
চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করীমের নেতৃত্বে বৈঠকে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ, যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান, জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, আশরাফ আলী আকনসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে এ বৈঠকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব আতাউল্লাহ আমিন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী, মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বাহাউদ্দিন জাকারিয়া ও সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান কাসেমী, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, নায়েবে আমির আহমদ আলী কাসেমী ও সাখাওয়াত হোসাইন, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন ইজহার ও সহসভাপতি আবদুল মাজেদ আতহারি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করীম আবরারও অংশ নেন।
বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে চরমোনাইয়ের পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আমরা সমমনা পাঁচটি ইসলামি রাজনৈতিক দল একত্র হয়ে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি। সামনে জাতীয় নির্বাচন, আমরা যেন ইসলামি দলগুলো একটি বাক্সে ভোট পাঠাতে পারি—সে বিষয়টি নিয়ে কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। অনেকের আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে। আলোচনায় আমরা সন্তুষ্ট।’
চরমোনাইয়ের পীর জানান, প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো শেষ হওয়ার পরই যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন।
সংস্কার ও নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময়টা কত দিন—এমন প্রশ্নের জবাবে ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, ‘সংস্কারের বিষয়ে নির্ধারিত সময় বলা যায় না। তবে সংস্কার যাতে দ্রুত হয়, এটাই আমাদের চাওয়া।’
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়ে সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, ‘এটি
সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। আমরা এ বিষয়ে একমত হয়েছি। তা না করলে প্রতিবাদে
আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব। ফ্যাসিস্ট, খুনি, টাকা পাচারকারীদের
বিচার ও টাকা ফেরত আনার বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি
সম্পন্ন করতে হবে।’