প্রতিনিধি কুমিল্লা

নিহত তিনজনের বাড়ির সামনে মানুষের ভিড়। বৃহস্পতিবার কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকুবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় একই পরিবারের তিন সদস্যকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হামলায় ওই পরিবারের আরেক নারী সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওই পরিবারের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে এলাকাবাসীকে উসকে দিয়ে বৃহস্পতিবার তিনজনকে খুন করা হয়েছে বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

নিহত তিনজন হলেন উপজেলার আকুবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামের খলিলুর রহমান ওরফে জুয়েলের স্ত্রী রোকসানা বেগম ওরফে রুবি (৫৩), তাঁর ছেলে মো. রাসেল মিয়া (৩৫) এবং মেয়ে তাসপিয়া আক্তার ওরফে জোনাকি (২৯)। গুরুতর আহত হয়েছেন রোকসানার আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (২৭)। তাঁকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

কড়ইবাড়ি এলাকার মানুষের অভিযোগ, নিহত রোকসানার পরিবার দুই দশকের বেশি সময় ধরে মাদক ব্যবসায় জড়িত। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় মাদকসংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের ওপর এলাকাবাসীর ক্ষোভ ছিল। গত মঙ্গলবার স্থানীয় এক শিক্ষকের মুঠোফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পক্ষ এই পরিবারের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীকে খেপিয়ে তোলে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। যাঁরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওসি বলেন, প্রাথমিকভাবে পুলিশ জানতে পেরেছে, রোকসানার পরিবারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবারের অভিযোগ রয়েছে। মাদক ব্যবসার বিষয়টি সামনে এনে এলাকাবাসীকে খেপিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে রোকসানা ও তাঁর দুই সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তবে এ ঘটনায় থানায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

এলাকাবাসী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুরাদনগর-নবীনগর সড়কের কড়ইবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রোকসানার বাড়ি। সেখানে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। গত মঙ্গলবার বাজারের একটি ওষুধের দোকান থেকে স্থানীয় কড়ইবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিনের একটি মুঠোফোন চুরি হয়।

অভিযোগ ওঠে, বোরহান উদ্দিন ওরফে মারুফ নামের এক তরুণ মুঠোফোনটি চুরি করেছেন। এই তরুণ রোকসানার মেয়ে তাসপিয়ার স্বামী মনির হোসেনের সঙ্গে কাজ করেন। তাঁর বাড়ি উপজেলার হায়দরাবাদ এলাকায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রোকসানার খুচরা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেন বোরহান।

শিক্ষকের মুঠোফোন চুরির অভিযোগ এনে মঙ্গলবার আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাচ্চু মিয়া ও স্থানীয় বাছির উদ্দিনের নেতৃত্ব বোরহানকে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে বোরহানকে ছাড়িয়ে নিতে যান রোকসানা। সেখানে বাচ্চু-বাছিরসহ অন্যদের সঙ্গে রোকসানা ও তাঁর পক্ষের লোকজনের বাগ্‌বিতণ্ডা ও একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনাকে ঘিরে পরদিন বুধবারও দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এসব নিয়ে দুই পক্ষে উত্তেজনা চলছিল।

বৃহস্পতিবার সকালে কড়ইবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আসেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া। এ সময় তাঁদের সঙ্গে রোকসানা ও তাঁর মেয়েদের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ইউপি সদস্য বাচ্চুকে চড় দেন রোকসানা। এরপরই রোকসানার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। একপর্যায়ে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই রোকসানা, রাসেল ও তাসপিয়ার মৃত্যু হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, নিহত ব্যক্তিদের মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হয়। এলোপাতাড়ি পেটানো হয় এবং কুপিয়ে জখম করা হয়। এ সময় প্রাণভয়ে রোকসানার স্বামী খলিল ও আরেক মেয়ে পালিয়ে যান।

সরেজমিন যা দেখা গেল

ঘটনার পর থেকেই কড়ইবাড়ি এলাকা পুরুষশূন্য। ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল, ইউপি সদস্য বাচ্চু ও বাছিরকেও এলাকায় পাওয়া যায়নি। তাঁদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও কারও কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী বলেন, পুরো ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন এলাকার মৃত বারো মিয়ার ছেলে বাছির উদ্দিন। রোকসানার পরিবারের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ তুলে তিনি সবাইকে উসকে দেন। এরপরই শুরু হয় হামলা।

বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নিতে লাশ তিনটি ভ্যানে তোলা হয়েছে। পুলিশ মরদেহ তুলে নেওয়ার পর সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত দেখা যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ উদ্ধার করার আগে রোকসানার রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে ছিল বাড়ির ভেতরে। পাশেই ছয়তলা ভবনের গলিতে পড়ে ছিল রাসেলের মরদেহ। আর বাড়ির বাইরে রাস্তার পাশে ছিল রোকসানার মেয়ে তাসপিয়ার মরদেহ।

ঘটনাস্থলে পাওয়া যায় নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তারকে। কোলে ১০ মাসের সন্তানকে নিয়ে কান্না করছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে ওই বাড়ি থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেন।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মীম আক্তার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘মোবাইল ফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পরিকল্পিতভাবে তিনজনকে খুন করা হয়েছে। বুধবার বাছির আমার স্বামীকে কল দিয়ে বলেছিল, তার পুরো পরিবারকে শেষ করে দেবে। তখন আমার স্বামী বলেছেন, পারলে তুই কিছু করিস। কিন্তু তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি, এমন ঘটনা ঘটবে।’

মীম আক্তার বলেন, ‘আগের দিন বুধবার বাগ্‌বিতণ্ডা ও হাতাহাতির পর আমার স্বামী আমার বাবার বাড়িতে ছিলেন। সকালে ঝামেলার কথা শুনে তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে কড়ইবাড়ি আসেন। বাড়ির কাছে আসতেই তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়। ইট দিয়ে থেঁতলে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়। আমার স্বামী বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে মারিস না, আমার ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে।’

মীম আক্তার বলেন, ঘটনার সময় তিনি স্বামীর মোটরসাইকেলের পেছনে সিএনজি অটোরিকশায় বসা ছিলেন।

মীম দাবি করেন, তাঁদের বিয়ে হয়েছে দুই বছর। তিনি স্বামীর পরিবারে মাদক কারবারের কিছুই দেখেননি। পুরো ঘটনাই পরিকল্পিত। তিনি তাঁর স্বামীসহ তিনজনকে হত্যার বিচার চান।

মাদক কারবারে জড়িত পুরো পরিবার: দাবি এলাকাবাসীর

এলাকাবাসীর দাবি, রোকসানার পরিবার দুই দশকের বেশি সময় ধরে মাদক কারবারে জড়িত। মাদকের টাকায় তাঁরা ব্যাপক সম্পদ গড়েছেন। একাধিকবার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলেও জামিনে বের হয়ে আবার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর স্বামী, প্রত্যেক সন্তান এবং মেয়েজামাইও মাদক কারবারে জড়িত। এ জন্য এলাকার মানুষ তাঁদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, রোকসানার ছয়তলা বিশাল বাড়ি। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে তিনতলা ও একতলা আরও দুটি ভবন রয়েছে। পাশেই একটি দোতলা মার্কেট। সবই তাঁদের।

কুমিল্লা জেলা পুলিশ ও বাঙ্গরা বাজার থানা-পুলিশের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত রোকসানার বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ তিনি গ্রেপ্তার হন। এর পর থেকে তিনি জামিনে ছিলেন। এ ছাড়া রোকসানার ছেলে রাসেলের বিরুদ্ধে ৯টি, মেয়ে তাসপিয়ার বিরুদ্ধে ৫টি, রুমার বিরুদ্ধে ২টি, তাসপিয়ার স্বামী মনিরের বিরুদ্ধে ১১টি, আরেক মেয়ের স্বামী আমির হামজার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। সব মামলাই মাদকের।

কড়ইবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন অভিযোগ করেন, ‘রোকসানা মাদক কারবারি। তাঁর কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। কিন্তু এভাবে তাঁদের হত্যা করা হবে, সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা পুরো ঘটনা তদন্ত করে দেখার দাবি জানাচ্ছি।’

রোকসানার বাড়ির পাশে একটি দোকানের ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোকসানা ইউপি সদস্য বাচ্চুকে থাপ্পড় মারার পরেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো ঘটনা শেষ। এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল, আজ (বৃহস্পতিবার) সেটির বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। রোকসানা অনেক আগে থেকেই বেপরোয়া। তবে ঘটনার জন্য এলাকার মানুষকে উসকে দেওয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান বলেন, রোকসানা ও তাঁর পরিবার মাদক কারবারি বা বড় কোনো অপরাধী হলেও এলাকার মানুষের উচিত ছিল, তাঁদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া। এভাবে মানুষকে হত্যা করা বা আইন হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।