মাসুম বিল্লাহ ঢাকা
![]() |
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ৮ আগস্ট রাতে বঙ্গভবনে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
গত ক’দিন ধরে জাতীয় রাজনীতি সরগরম ছিল চারটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে—কুমিল্লার মুরাদনগরে ধর্ষণের অভিযোগ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়ার কাছ থেকে অ্যামোনেশন ম্যাগাজিন (গোলাবারুদের খালি খাপ) উদ্ধারের বিষয়, জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়া এবং নির্বাচনব্যবস্থায় সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি চালুর দাবি। এসব ইস্যু ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গনজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।
ঠিক এই সময়ে হঠাৎ করে সামনে আনা হলো পুরনো এক প্রসঙ্গ—রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়া হবে কি না। রটানো হলো, তাঁকে অপসারণ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসানোর পরিকল্পনা চলছে। চলমান ইস্যুগুলো থেকে নজর ঘোরাতে এটি পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো গুজব বলেই মনে করছেন অনেকেই।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের কৌশল শেখ হাসিনার শাসনামলেও দেখা গেছে বারবার। যখন কোনো ঘটনা নিয়ে সরকার চাপে পড়ে, তখনই সামনে আনা হতো নতুন কোনো আলোড়ন—জঙ্গি হামলা, আগুন লাগা বা দুর্নীতির কেলেঙ্কারি। এখনো সেই পুরনো ছকেই চলা হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।
তাঁরা উদাহরণ হিসেবে বলছেন ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলের কথা। তখন পুরো পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। অথচ বাংলাদেশ সরকার তখন ব্যস্ত ছিল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে আতশবাজি, র্যালি ও অনুষ্ঠানে। সেই সময়েই সামনে আনা হয় ক্যাসিনো-কেলেঙ্কারি। একে একে ধরা পড়েন ওমর ফারুক, সম্রাট, পাপিয়া, জি.কে. শামীমসহ অনেকে। পরে যখন টিকা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়, তখন সামনে আসে সাহেদ-সাবরিনার ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট কেলেঙ্কারি।
বর্তমানে মুরাদনগরের ধর্ষণ, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নের মুখে পড়েছে সরকার। ঠিক তখনই সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয় ‘সাহাবুদ্দিন অপসারণ’ ইস্যু। অথচ এই বিষয়ে বিএনপি আগেই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছিল—তারা সাংবিধানিক কোনো জটিলতায় জড়াতে চায় না।
গত বছর সাহাবুদ্দিনের বিদেশে আবাস ও ব্যবসার তথ্য ছড়িয়ে পড়ার পরও বিএনপি জানিয়েছিল, তাঁরা এই ইস্যুতে আন্দোলনে যাবে না। বিশ্লেষকদের মতে, সাহাবুদ্দিন ব্যক্তি নয়, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংবিধান। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। ফলে তাঁকে সরানো হলে পুরো সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে।
গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর একমাত্র টিকে ছিল বঙ্গভবনের নেতৃত্ব। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপি, জামায়াত ও কোটা আন্দোলনের নেতারাও তখন সাহাবুদ্দিনের উপস্থিতিতে শপথ নিয়েছিলেন।
বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দুটি উপায় রয়েছে—একটি তাঁর নিজের ইচ্ছায় পদত্যাগ, অন্যটি সংসদে অভিশংসন। কিন্তু এখন সংসদ নেই, স্পিকারও পদত্যাগ করেছেন। ফলে দুটি পথই কার্যত বন্ধ।
সাবেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর ভাষায়, ‘রাষ্ট্রপতি যদি নিজে না সরে দাঁড়ান, তাহলে তাঁকে সরানোর আর কোনো উপায় নেই। সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি অপসারণ-অযোগ্য।’
তবে বিকল্প একটি উপায় হতে পারে—সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স পাঠিয়ে রাষ্ট্রপতির “নৈতিক স্খলন” আছে কি না, তা নিয়ে মতামত চাওয়া। কিন্তু সেখানে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই নৈতিক স্খলনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে কে?
বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রপতি পদ নিয়ে গুজব ছড়ালেও নির্বাচনী কর্মসূচি আটকে যাবে না। তবে বিএনপি যদি আগের মতোই সতর্ক থাকে এবং এসব বিভ্রান্তিমূলক আলোচনায় পা না দেয়, তাহলে এই ইস্যুর প্রভাব সীমিত থাকবে।
শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া সংবিধান বারবার পরিবর্তনের কারণে এখন তা এক গোলকধাঁধাঁয় পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৭ দফা সংশোধনের ফলে এর মধ্যে এমনসব অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে, যা এক সংকট থেকে আরেক সংকটে ঠেলে দিচ্ছে রাজনীতিকে।
নতুন প্রশ্ন উঠছে—নির্বাচনের মুখে আবারও কি নতুন কৃত্রিম ইস্যু ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে মূল আলোচনাকে আড়াল করতে? এই কৌশল কতটা কার্যকর হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।