{getBlock} $results={3} $label={ছবি} $type={headermagazine}

বিচারে বিলম্ব রোধে মামলা শুরুর আগে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার পরামর্শ প্রধান বিচারপতির

প্রকাশঃ
অ+ অ-

নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা

‘যথাসময়ে বিচার নিশ্চিত করতে পারিবারিক আদালতের পদ্ধতিগত জটিলতা নিরসন’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে, ১৪ জুলাই ২০২৫  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন    

কিছু ক্ষেত্রে মামলা শুরুর আগে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা করা যায়। তাতে মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও আদালতের ওপর চাপ কমবে বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

সোমবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে আয়োজিত এক জাতীয় পর্যায়ের কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। ‘যথাসময়ে বিচার নিশ্চিত করতে পারিবারিক আদালতের পদ্ধতিগত জটিলতা নিরসন’ শিরোনামে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা (সেলপ) কর্মসূচি এই কর্মশালার আয়োজন করে।

কর্মশালায় জানানো হয়, দেশের পারিবারিক আদালতে ৭২ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন। পারিবারিক বিরোধে দ্রুত ও সহজ বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ আদালতগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বিচারাধীন মামলার মধ্যে ৪ হাজার ৬০০-এর বেশি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে নিষ্পত্তিহীন অবস্থায় রয়েছে। এই দীর্ঘসূত্রতা হাজারো পরিবারকে আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর।

কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন চলছে। সাম্প্রতিক আইনগত ও প্রক্রিয়াগত সংস্কারগুলো শুধু আধুনিকায়নের জন্য নয়, বরং পুরো ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ, জবাবদিহিমূলক এবং জনগণকেন্দ্রিক করে তোলার লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। সংশোধিত আইনে মামলা দায়েরের আগে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা চালুর মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মামলা প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির পথ তৈরি হয়েছে। এতে প্রাথমিক পর্যায়েই সমাধান সম্ভব হবে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমে আদালতের চাপও কমবে।

১ জুলাই ‘আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। অধ্যাদেশ অনুসারে, প্রথমে ভুক্তভোগী নারীকে আইনি সহায়তা কার্যালয়ের মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করতে হবে। মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে কোনো পক্ষ প্রয়োজনে আদালতে মামলা করতে পারবেন।

সংশোধিত অধ্যাদেশের এই ধারা ৯টি আইনের সুনির্দিষ্ট কিছু ধারার ওপর প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১১ (গ) ধারা এবং যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮-এর ৩ ও ৪ ধারা, পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩-এর ৫ ধারা (বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, ভরণপোষণ, শিশুসন্তানের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান)।

এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১১ (গ) ধারার ক্ষেত্রে মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অধিকারকর্মীরা। তাঁরা বলেন, এর ফলে যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের শিকার নারীদের এখন থেকে মামলার আগে মধ্যস্থতায় যেতে হবে। এই সংশোধন নারীর মামলা করার আইনি অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে। ভুক্তভোগীকে অপরাধীর সঙ্গে আপস করতে বাধ্য করবে।

আজ ব্র্যাকের অনুষ্ঠানে আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, দেওয়ানি কার্যবিধিতে আনা পরিবর্তনের ফলে মামলার বিভিন্ন ধাপে সময় কমানো হয়েছে, রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া একই কাঠামোর ভেতরেই সম্পন্ন হচ্ছে এবং বারবার তারিখ পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত হয়েছে। হলফনামার মাধ্যমে সাক্ষ্য উপস্থাপনের বিধান আদালতের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করেছে।

প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, সম্প্রতি জারি করা অধ্যাদেশের মাধ্যমে ফৌজদারি কার্যবিধিতে নতুন বিধান যুক্ত হয়েছে। তদন্ত শুরুর আগে তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রাক্‌-তদন্ত প্রতিবেদন দিতে হবে। এতে গুরুত্বহীন অভিযোগ আগেই বাদ যাবে। ফলে রাষ্ট্রপক্ষের সময় ও সম্পদ বাঁচবে। আর অভিযুক্ত ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার আরও সুরক্ষিত হবে।

ব্র্যাকের আয়োজনে ‘যথাসময়ে বিচার নিশ্চিত করতে পারিবারিক আদালতের পদ্ধতিগত জটিলতা নিরসন’ শীর্ষক কর্মশালায় অতিথিরা। রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে, ১৪ জুলাই ২০২৫ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন    

কর্মশালা শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ নিয়ে প্রথম আলোর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, আইনটি প্রয়োগের পর এর কার্যকারিতার দিকে নজর রাখবে উচ্চ আদালত। যদি নারীদের আইনি অধিকার লঙ্ঘন হয় বা নারীদের জন্য সুফল বয়ে না আনে, তাহলে তা নিয়ে উচ্চ আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণ সরকারকে জানাবেন। সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। যেকোনো সময় আইনে সংশোধন আনা সম্ভব।

কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। তিনি বলেন, পারিবারিক আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা অনেক বেশি। দিন দিন এ বোঝা আরও বাড়ছে। দেশে পারিবারিক আদালতের আলাদা কোনো স্থাপনা নেই। বিচারকদের ক্ষমতা সীমিত। পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য সম্পূর্ণ কার্যকর বিশেষায়িত আপিল আদালত প্রয়োজন।

কর্মশালায় ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ বলেন, সমতাভিত্তিক সমাজ তখনই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যখন নারী ও শিশুদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে। এ জন্য সমাজের সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি সংস্থা, প্রত্যেক ব্যক্তির সদিচ্ছা থাকতে হবে। একসঙ্গে সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে।

কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য দেন ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা (সেলপ) ও জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক শাশ্বতী বিপ্লব।

কর্মশালায় বিচার বিভাগ, নীতিনির্ধারক, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা অংশ নেন। এতে পাঁচটি বিভাগীয় কর্মশালা থেকে উঠে আসা সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করা হয়। বিভাগীয় কর্মশালাগুলোতে ৫১ জেলার ১১৭ জন বিচারক ও ১০ জন আইনজীবী অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালায় বক্তারা বলেন, সমন জারি করার মতো প্রক্রিয়াগত জটিলতাই বিচারপ্রাপ্তিতে বড় বাধা।

কর্মশালায় প্রস্তাবিত মূল সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) বাধ্যতামূলক করা এবং এর আইনি বৈধতা দেওয়া, ডিক্রি বাস্তবায়ন পদ্ধতি সহজ করা এবং বিয়ের রেজিস্ট্রেশন ও মামলার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো। এ ছাড়া অংশগ্রহণকারীরা উত্তরাধিকার ও পারিবারিক সহিংসতার মতো বিষয়গুলোকে পারিবারিক আদালতের আওতায় আনা এবং পৃথক পারিবারিক আদালত ও আপিল আদালত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোনালী রানী উপাধ্যায় এবং সাতক্ষীরার সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট জাজ মো. তরিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের লিগ্যাল এইড অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভোকেসি কর্মসূচির লিড এ টি এম মোরশেদ আলম।

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন