বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশিষ্ট সাধক, জ্ঞানতপস, বিদগ্ধ শিক্ষক এবং বাংলা একাডেমির ফেলো মুজিবর রহমান বিশ্বাস ছিলেন তাঁর সময়ের এক 'প্রমিথিউস'। তিনি দেবতাদের আগুন চুরি করে দেননি, কিন্তু স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি মানবিক সমাজের- একটি বৈষম্যহীন, মর্যাদাবান মানুষের সমাজের। সে স্বপ্ন তিনি শুধু দেখেননি, দেখিয়েছেনও। এ কারণেই তাকে সারা জীবন সহ্য করতে হয়েছে লাঞ্ছনা, নিপীড়ন, অত্যাচার ও অবমাননা। শুধু রাষ্ট্র নয়- সমাজের ভেদবুদ্ধি, ক্ষুদ্র স্বার্থ, অহমিকা ও হীন চক্রান্তও বারবার আঘাত করেছে তাঁকে। তাঁর লেখার পরতে পরতে এসব অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তীব্র বেদনাভরে।
চলতি বছর, ২০২৫ সালে, এই শিক্ষাগুরুর জন্মশতবর্ষ। গত ১ জুলাই নীরবে কেটে গেল তাঁর ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।
মুজিবর রহমান বিশ্বাসের জন্ম পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডা গ্রামে। তরুণ বয়সে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন এবং প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজতান্ত্রিক সমাজের সম্ভাবনায়- একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্নে। কিন্তু সেই স্বপ্নই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি তিনি সেসময়ের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও লিখেছেন। তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন, কীভাবে পার্টির কিছু নেতা দলকে নিজেদের ব্যক্তিগত জমিদারি মনে করতেন।
গ্রামের অন্ধকার আর পশ্চাৎপদতার ভেতরে দাঁড়িয়ে তিনি বলতেন নবজাগরণের কথা, রেনেসাঁসের কথা। তিনি ছিলেন আলোর বংশীবাদক, যিনি গহিন অন্ধকারে গান গেয়ে ঘুম ভাঙাতেন মানুষের।
তাঁর লেখা দু’টি বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে এসব কথার প্রমাণ তুলে ধরাও যায়।
আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘আমি’ থেকে:
'মানুষের
আত্মার যন্ত্রণা, ব্যক্তিত্বের যন্ত্রণা- এই যন্ত্রণা মানুষকে চিরকাল সহ্য
করে যেতে হয়। মানুষ যদি মুক্ত, স্বচ্ছন্দ জীবনের পরিবেশ পায়, তারচেয়ে বড়
সুখ আর কিছু হতে পারে না। অথচ পরিবেশ পরিবর্তনই সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমি কেন
ধ্বংস হলাম? আমার কোনো সাংসারিক জ্ঞান ছিল না। আমি উলুবনে মুক্তা ছড়িয়ে
এসেছি।
সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি কী দেখলাম? কোথাও পূর্ণ মানুষের
ছক দেখতে পেলাম না। জন্তু-জানোয়ারের মতো, সাপ-পোকামাকড়ের মতো মানুষের
সংখ্যা সমাজে খুবই বেশি বলে মনে হয়। সমাজ দিন দিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
একসময়
মনে হয়েছিল, সাহিত্যই হয়তো সেই শক্তি- যা মানুষকে ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ গণ্ডি
থেকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু আমাদের মুসলিম সমাজে সাহিত্যের পরিবেশ
সেদিনও ছিল না, আজও নেই। আমি সারাজীবন উদারতা ও মহত্ব কামনা করেছি। কোনো
সংকীর্ণ পরিবেশে আমি থাকতে পারিনি।
আমার জীবন কেন ধ্বংস হলো? আমি
সমাজের গভীর তলদেশ থেকে কর্মী তৈরি করতে চেয়েছিলাম। অনেক মানুষের ভাত আমি
খেয়েছি। এর পেছনে ছিল একটাই ভাবনা—সব বাড়ি আমার, সব মানুষ আমার, সব
ছেলেমেয়ে আমার।
হায়, হতভাগ্য সমাজ! তুমি তা বুঝলে না। আমার
জনপ্রিয়তাই আমার ধ্বংসের কারণ হয়েছে। আমি চিররুগী, চিরভিখারী। এত বয়সেও আমি
শিশুর মতো সরল। আমার দেহের গঠনই এমন যে আমি সহজ-সরল, শিশুর মতোই। আমার বুক
ভেঙে গেছে। আমি এক মহান, অখণ্ড, অনন্ত সাধারণ জনগোষ্ঠী গড়তে চেয়েছিলাম।
সর্বজনীন হতে চেয়েছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই আমার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে।
সর্বজনীন হওয়ার দাবি আমারই, কারণ আমি একজন লেখক। মানুষ যদি মানুষের সমাজে এক কণা আশ্রয় না পায়, তবে সে সমাজ দানবের সমাজ।'
কবিতাগ্রন্থ ‘জন্মদিনে’ থেকে:
“কত যে অন্ধ তামসিক দিনরজনী পার হয়ে গেল, জীবনের কতদিন যে বৃথা, সৃষ্টিশূন্যভাবে কেটে গেল—আজ তার হিসাব মেলানোও কঠিন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন পেছনের দিনগুলোর দিকে তাকাই, তখন দেখি—সবই যেন এক রাশ কালিতে ঢেকে গেছে।
‘শর্বরীর প্রতীক্ষা’- এই কালে কি তার অবসান ঘটতে পারে? তা তো মনে হয় না। বরং এই কালে প্রতীক্ষা শুধু দীর্ঘায়িতই হতে পারে।
এই কালে যদি গোটা দেশ, জনপদ পাষণ্ডতা, বীভৎসতা আর হীনতা–ক্ষুদ্রতার স্রোতে ভেসে যায়, তাহলে মানুষের সামনে আশার নিশান তুলে ধরবে কে?
ব্যক্তিগত জীবনের এই ব্যর্থতা—তা তো মনে হয় না। এই কালে মানুষের প্রাণকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। দুর্বলকে ভেঙে চুরমার করে ফেলা হয়।
মানুষ ক্ষুদ্রতা নিয়ে জোট বাঁধে।
ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি যদি শুধু মসীলিপ্ত আর কণ্টকাকীর্ণ হয়, তবে দোষই বা দেব কাকে?
বড়ই নিষ্ঠুর আমাদের সমাজ। বড়ই বিভীষিকাময়। মানুষের ব্যক্তিক ও পারিবারিক জীবন—সংকীর্ণ, কলুষিত, ভাঙনমুখী এবং অবক্ষয়গ্রস্ত।'
প্রিয় দেশবাসী,
যত
ক্ষুদ্রই হই, আমি একজন লেখক। আর লেখক কোনো নির্দিষ্ট এলাকার হয় না। লেখক
সর্বকালের, সর্বদেশের, সর্বভুবনের। আমার রচনায় অবশ্যই সর্বজনীনতা থাকতে
হবে। একজন লেখক হিসেবে আমি শুধু ঈশ্বরদীর নই, শুধু উত্তর বা দক্ষিণ বাংলার
নই-আমি সারা বাংলাদেশের।
সারা বাংলাদেশ যেন আজ মানবতার এক বধ্যমঞ্চে
পরিণত হয়েছে। আমি জনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে, জনতার গভীরে নেমে যাওয়ার
ফলাফলের স্বাদ হাতে হাতে টের পাচ্ছি।
আমি বারবার বলছি-এশিয়া মহাদেশের এক দরিদ্র লেখক হিসেবে, এশিয়ার কবি-সাহিত্যিক, লেখক সমাজ, কর্মী, সাংবাদিক ও সাধকদের কাছে বারবার আবেদন জানাচ্ছি- তারা যেন মানবজীবনের পরিবেশকে বিবেচনায় নেন।
আত্মভোলা, স্বল্পাহারী, বৈষয়িক দিক থেকে উদাসীন এই মানুষটি-মুজিবর রহমান বিশ্বাস-নিজ সমাজের কাছেই তাঁর প্রাপ্য স্থান পাননি।
এই
জ্ঞানতপস, সাহিত্যসাধক, শিক্ষাগুরুকে আমরা জীবিতকালে সম্মান দিতে পারিনি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁকে যথার্থ মর্যাদা দিতে পারিনি।
এ
কারণে আমরা পদ্মা ট্রিবিউন পরিবারের পক্ষ থেকে ঈশ্বরদীবাসীর প্রতি
বিনীতভাবে একটি আবেদন জানাচ্ছি-এই আলোকিত ব্যক্তিত্বকে মৃত্যুর পরে হলেও
মর্যাদায় আসীন করুন।
তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানাতে ঈশ্বরদীর কোনো
সড়কের নামকরণ, অথবা 'ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন'-এর নাম পরিবর্তন করে 'মুজিবর
রহমান বিশ্বাস স্টেশন' রাখা-এটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ
হতে পারে।
এ বিষয়ে ঈশ্বরদীর আলোকিত ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বদের আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।