[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

দুই মাস ধরে টেকনাফ বন্দর বন্ধ, চোরাচালানে উল্টো গতি

প্রকাশঃ
অ+ অ-

কক্সবাজারের টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে মিয়ানমারে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ আছে টানা দুই মাস। তাতে শতাধিক ব্যবসায়ী পড়েছেন বিপদে। গুদামে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার পণ্য। মালামাল না থাকায় পুরো বন্দর ফাঁকা পড়ে আছে। গতকা বৃহস্পতিবার দুপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

টানা দুই মাস ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। সীমান্তে চোরাচালান নিরুৎসাহিত করতে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্য চালু হয়। এখন আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় সীমান্তে ৩৩টি চোরাই পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার মালামাল। তাতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন শতাধিক আমদানি-রপ্তানিকারক।

এ ছাড়া বন্দরের গুদামে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার পণ্য। আর প্রতি মাসে ১২০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে স্থলবন্দর পরিদর্শন করে বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা, বন্দর কর্তৃপক্ষ, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। ব্যবসায়ীরা জানান, রাজস্ব আদায় করা সত্ত্বেও সাত-আট কোটি টাকার পণ্য বন্দরের গুদামে দুই মাসের বেশি সময় ধরে পড়ে আছে। এর বেশির ভাগ সিমেন্ট, আলু ও পেঁয়াজ। ইতিমধ্যে ১৩৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ ও ১২ টন আলু এবং ১২০টির বেশি সিমেন্টের ব্যাগ নষ্ট হয়ে গেছে।

বন্দর ও শুল্ক কর্মকর্তারা বলছেন, সীমান্ত–সংক্রান্ত জটিলতার কারণে স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি চালু করা যাচ্ছে না। বন্দরের কয়েকজন আমদানি-রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ী গতকাল দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে বাণিজ্যসংকট নিরসনে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ এখন দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠীর (আরাকান আর্মি) হাতে। বাণিজ্যসংকট নিরসনে সীমান্তরক্ষী বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের অভিমত দরকার। আগামী ৮ আগষ্ট সবাইকে নিয়ে বৈঠক করে বন্দরের সংকট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত বছরের ফেব্রয়ারি মাসের শুরুতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। টানা ১১ মাস যুদ্ধের পর ৮ ডিসেম্বর আরকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয়। এই পরিস্থিতির আগে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানি হতো আকিয়াব বন্দর দিয়ে। সংঘাতের কারণে গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে আকিয়াবের সঙ্গে টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হলে আরাকান আর্মির সহায়তায় মংডু টাউনশিপ দিয়ে বাণিজ্য শুরু হয়। গত ১৩ এপ্রিল মংডু থেকে আসা কাঠভর্তি একটি ট্রলার জব্দ করে বিজিবি। মূলত এর পর থেকে স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।

ফাঁকা স্থলবন্দর, নষ্ট হচ্ছে পণ্য

সরেজমিনে গতকাল দেখা যায়, পুরো বন্দর ফাঁকা পড়ে আছে। মাঠে কোনো পণ্য মজুত নেই। নাফ নদীর জেটিতে পণ্যবোঝাই ট্রলার-জাহাজও নেই। বেকার হয়ে গেলেন বন্দরের কাজে যুক্ত শ্রমিকেরা।

সরেজমিনে কথা হয় শ্রমিক আবদুল নবীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বন্দরের মালামাল খালাস করে দিনে ৭০০ টাকা আয় হতো। তা দিয়ে চলত সংসার। দুই মাস ধরে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ। তাই এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বন্দরে শ্রমিকের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৯০ শতাংশ শ্রমিক বেকার জীবন কাটাচ্ছেন।

বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বন্দরের কয়েকটি গুদামে ২ হাজার ৬০০ বস্তা আলু, ১৮ হাজার ৫০ বস্তা সিমেন্ট, ১৩৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ ছাড়াও বিপুল পরিমাণ কোমল পানীয়, মিনারেল ওয়াটার, চিপস, চানাচুর, বিস্কুট, প্লাস্টিক পণ্য মজুত রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইতিমধ্যে সব পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। আলু নষ্ট হয়েছে ১২ মেট্রিক টনের বেশি। কয়েক শ বস্তা সিমেন্ট নষ্ট হওয়ার পথে।

গুদামে দেড় মাস ধরে পড়ে আছে ‘এক্সপ্রেস এজেন্সির’ মালিক ও টেকনাফের ব্যবসায়ী ওমর ফারুকের ৫০০ বস্তা আলু। সবুজ অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক নুরুল কায়েস সাদ্দামের ২ হাজার ১০০ বস্তা আলু।

কক্সবাজারের টেকনাফ স্থল বন্দরে পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

এক্সপ্রেস এজেন্সির প্রতিনিধি মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, রাখাইন রাজ্যের দখলদার আরাকান আর্মির সম্মতি না পাওয়ায় পণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার থেকেও কোনো পণ্য টেকনাফ স্থলবন্দরে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। তাতে শতাধিক ব্যবসায়ী বিপাকে পড়েছেন। এখন দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চালু করতে সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার।

কাস্টমস সূত্র জানায়, গত মার্চে রাখাইন রাজ্য থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি হয়েছিল ৬৭৫ দশমিক ৪৩ মেট্রিক টন পণ্য। তাতে সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। একই সময় বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রপ্তানি হয় ৩ হাজার ৪৫৫ মেট্রিক টন পণ্য।

বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের টেকনাফের মহাব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মালিকবিহীন অবস্থায় বিজিবির জব্দ করা কাঠগুলো আমাদের হেফজতে রয়েছে।’

টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা হাসান মাসুদ মুন্সী বলেন, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পযর্ন্ত চার মাসে রাখাইন রাজ্যে সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ২৩৮ টন, আলু রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ১৭৪ টন। সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থাকায় সরকার প্রতিদিন ৪ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

বাড়ছে চোলাচালান

কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, সীমান্ত চোরাচালানকে নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য চালু হয়েছিল। দুই বছর আগেও বাণিজ্য জমজমাট ছিল। চোরাচালান ছিল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। এখন স্থলবন্দর বন্ধ থাকায় সুবিধা নিচ্ছেন দুই দেশের চোরাচালানিরা।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমানে টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলার অন্তত ৩৩টি পয়েন্ট দিয়ে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, জ্বালানি, আলু, পেঁয়াজ, রাসায়নিক সার, সিমেন্ট, রড, ওষধ, প্লাস্টিক পণ্য মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা, আইসের বড় বড় চালান। সঙ্গে আনা হচ্ছে হাজার হাজার গরু-মহিষ। নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে গরুসহ মাদকের চোরাচালান বেড়েছে কয়েক গুণ।

বিজিবি ও কোস্টগার্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে মিয়ানমার থেকে পাচারের সময় ৪৫টির বেশি অভিযানে ১২ লাখের বেশি ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে। এ সময় বিপুল পরিমাণ সিমেন্ট, ইউরিয়া সার, খাদ্যপণ্যসহ অন্তত ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন