পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক
‘আমার ছোট ব্যাটা তার বাপেক (বাবাকে) কতই ন্যা বালো (ভালো) বাইসছে। তার চিকিৎস্যার নিগ্যা (জন্য) কত্তো চেষ্টাই ন্যা কইরতো। এইবাবে (এভাবে) বাপ-ব্যাটা এহুস্তার (একসঙ্গে) মইরবো আমি মাইনব্যার পাইরত্যাছি ন্যা। আমার ব্যাটার বউ, ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা এহুন তাগোরে কী উপায় ওইবো। এসব ভাইবলে (ভাবলে) অন্তর পুইড়া ওটে।’
কথাগুলো বলছিলেন ট্রাকচাপায় নিহত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলঙ্গা ইউনিয়নের পুরান বেড়া গ্রামের আবদুল মান্নান খন্দকারের স্ত্রী ও জুয়েল খন্দকারের মা রোজুবা খাতুন (৬০)।
আজ বুধবার দুপুরে উপজেলার পুরান বেড়া গ্রামে নিহত ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চলছে স্বজনদের মাতম। বাবা–ছেলের মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে বৃষ্টিতে ভিজেই প্রতিবেশীসহ দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন স্বজনেরা। কিছুক্ষণ পরপর নিহত জুয়েলের ফুটফুটে দুটি সন্তানকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলেন দাদি রোজুবা খাতুন। এ সময় তাঁদের সান্ত্বনা দিতে আসা প্রতিবেশীরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। তাঁদের সবার মুখে একটাই কথা, এই শিশু সন্তান দুটির এখন কী হবে। পরিবারটি এখন কীভাবে চলবে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে উল্লাপাড়া উপজেলার চড়িয়া শিকার এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ট্রাকচাপায় ব্যাটারিচালিত ভ্যানে থাকা বাবা আবদুল মান্নান খন্দকার (৭০) ও তাঁর ছেলে জুয়েল খন্দকার (৩৫) নিহত হন। এ ছাড়া ভ্যানটিতে থাকা মান্নানের বড় ছেলে রাসেল খন্দকার (৪০) ও অটোভ্যানটির চালক আবদুল হাকিম (৪৫) আহত হন।
হাইওয়ে পুলিশ, নিহত দুজনের পরিবার ও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, আবদুল মান্নান বার্ধক্যজনিত কারণে বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। মঙ্গলবার সকালে তাঁকে ব্যাটারিচালিত ভ্যানে করে নিয়ে উপজেলার হাটিকুমরুল গোলচত্বর হয়ে জেলার এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছিলেন ছেলে জুয়েল খন্দকার। সঙ্গে ছিলেন মান্নানের বড় ছেলে রাসেল খন্দকার। সকাল পৌনে সাতটার দিকে চড়িয়া শিখা এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক পারাপারের সময় ভ্যানটিকে চাপা দেয় বেপরোয়া গতির একটি ট্রাক। এতে ভ্যানটি দুমড়েমুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই বাবা-ছেলে (মান্নান ও জুয়েল) নিহত হন। এ ঘটনায় নিহত মান্নানের বড় ছেলে ও অটোভ্যানের চালকও গুরুতর আহত হন। পরে তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
নিহত মান্নানের ছোট ভাই আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমার বড় ভাইয়ের দুই ছেলে। এর মধ্যে বড় ছেলে অনেক আগেই পৃথক হয়ে অন্য জায়গায় বাড়ি করে পরিবার নিয়ে থাকে। পুরান বেড়া গ্রামে তাদের বাড়িতে আমার ভাই, ভাবি, তাদের ছোট ছেলে তার বউসহ ছয় বছর বয়সের একটি ছেলে ও দেড় বছর বয়সের একটি মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার। আমার বড় ভাই আগে ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করত। বয়স ও অসুস্থতার কারণে বর্তমানে বাড়িতেই থাকত। নিহত ছোট ভাইস্তা জুয়েল খন্দকারের বাড়িতেই একটি ছোট আকারের টুপির কারখানা আছে। সেই কারখানায় টুপি উৎপাদন করেই তাদের সংসার চালাত জুয়েল। এখন পরিবারে আয়রোজগার করার মতো কেউ রইল না।’
নিহত জুয়েল খন্দকারের স্ত্রী মুন্নি খাতুন বলেন, ‘এখন এই ছোট ছোট দুটি সন্তান ও আমার বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে আমি কোথায় যাব। কীভাবে চলব?’
মঙ্গলবার দুপুরে লাশ দুটি বাড়িতে আনার পর তাঁদের একটুখানি দেখতে আশপাশের শত শত মানুষ বাড়িতে ভিড় করতে থাকেন। এরপর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে জানাজা শেষে পুরান বেড়া কবরস্থানে তাঁদের দাফন করা হয়।
পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মান্নান ও জুয়েলের লাশ হস্তান্তর হয়েছে বলে জানান হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রউফ। তিনি বলেন, ট্রাকটি জব্দ করা গেলেও চালক ও তাঁর সহকারী পালিয়ে গেছেন। তাঁকে ধরতে কাজ করছে পুলিশ।