সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন (সামনে) ও আনিসুল হককে (পেছনে) হাজতখানা থেকে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন  

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের কাঠগড়ায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে তোলার পর তাঁর দুই হাত পেছনে নিয়ে পরানো হাতকড়া খুলে দেয় পুলিশ। তাঁর বাঁ হাতে পরানো ছিল হাতকড়া। তখন সকাল ১০টা ৩ মিনিট। বিচারক এজলাসে আসেননি।

আনিসুল হকের সামনে এগিয়ে যান তাঁর আইনজীবী আসিফুর রহমান। তখন আনিসুল তাঁর আইনজীবী আসিফুরকে বলেন, আজ কোন কোন মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে?

জবাবে আসিফুর বলেন, ‘স্যার, আজ আপনার দুটি মামলা রয়েছে। একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন, অন্যটি রিমান্ড শুনানি।’

আনিসুলের সামনে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে ছিলেন। আনিসুলের ডান পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি আনিসুলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

মোশাররফের কাছে আনিসুল জানতে চান, আজ কোন মামলায় তাঁর শুনানি। হাসিমুখে মোশাররফ জানান, কোন মামলায় আজ তাঁকে আনা হয়েছে, তা তিনি জানেন না।

সকাল ১০টা ১০ মিনিটের দিকে বিচারক এজলাসে আসেন।

তখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলতে থাকেন, বনানী থানার একটি মামলায় আনিসুলকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়েছে। পুলিশের আবেদন মঞ্জুর করার পর বিচারক আসামি আনিসুলের নাম ধরে ডাকেন। আনিসুল তখন আদালতে উপস্থিত আছেন জানিয়ে দেন।

এরপর বিচারক আনিসুলের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাকে বনানী থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো।’

পরে মোশারফকে পল্টন থানার একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। একই সঙ্গে তাঁর ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। তখন মোশাররফের পক্ষের আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘আমার মক্কেলের বয়স এখন ৮২। তাঁর হার্টে রিং পরানো হয়েছে। তিনি খুব অসুস্থ। তাঁকে ১৫টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। প্রতিটি মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন। যখনই তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পাবেন, তখনই তাঁকে নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।’

মোশাররফের আইনজীবী আদালতকে আরও বলেন, ‘আমার মক্কেল একজন বয়স্ক মানুষ। আপনার (বিচারক) সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর শরীরটা ভালো নেই। তিনি কোনো ধরনের হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত নন। তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’

মোশাররফের রিমান্ডের সপক্ষে আদালতে যুক্তি তুলে ধরেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি আদালতকে বলেন, ‘আপনার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনার অন্যতম সহযোগী। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। যিনি গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে আসেন, তিনি সাফাই গান, কোনো অপরাধের সঙ্গে তিনি জড়িত নন।’

উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত মোশারফের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে আনিসুলের সঙ্গে মোশাররফ কথা বলেন। তিনি আনিসুলের কাছে বলেন, মামলার ঘটনার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

তখন মোশাররফকে আনিসুল বলেন, ‘এ কথা বলে কোনো লাভ নেই।’ আনিসুলের এ কথা শুনে মোশারফ তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হেসে দেন।

এ সময় আনিসুলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা মাঈন হাসান সজীব। শাহবাগ থানার একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় তাঁর তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। তিনি আনিসুলকে বলেন, ‘স্যার, আমার লেখাপড়া এখনো শেষ হয়নি। কবে লেখাপড়া শেষ করব, কপালে কী আছে জানি না, স্যার।’ তখন আনিসুল ওই ছাত্রলীগ নেতাকে সান্ত্বনা দেন।

‘আমি ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি’

আগে থেকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আনিসুল ও মোশাররফ। তাঁদের সামনে ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। বিচারক এজলাসে ছিলেন। তবে তখনো শুনানি শুরু হয়নি।

এ সময় দুজন পুলিশ সদস্য বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারীকে কাঠগড়ায় হাজির করেন। তখন তিনি কাঠগড়ায় পায়চারি করছিলেন। তাঁর স্ত্রী নাজমা আক্তার কাঠগড়ার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবুল সরদার তাঁর স্ত্রীর দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন। কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বাবুল চাখারীর নাম ধরে ডাকা হয়। তিনি কাঠগড়ার সম্মুখভাগে এগিয়ে যান।

বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারীকে আদালত থেকে হাজতখানায় নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন  

একপর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, পল্টন থানায় দায়ের করা বদরুল ইসলাম সাঈমন হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি বাবুল চাখারী। তাঁকে ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করা হয়েছে।

এ সময় বাবুল চাখারী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আদালতের সামনে কথা বলা শুরু করেন। বাবুল চাখারী আদালতের কাছে দাবি করেন, তিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। তাঁর দল বাংলাদেশ পিপলস পার্টি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোটের শরিক। গত বছরের নভেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। চারটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। চারটি মামলায়ই তিনি জামিন পেয়েছেন।

বাবুল সরদার চাখারী আদালতকে বলেন, ‘আমার দল বিএনপি জোটের সঙ্গে রয়েছে। আমি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। এখন আমাকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সহযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। আমি বিনা অপরাধে আট মাস ধরে কারাগারে আছি।’

বাবুল চাখারীর এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি আদালতকে বলেন, তদন্তে বাবুল চাখারীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত বাবুল চাখারীর তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।পরে ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোটে ছিল বিপিপি। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনেও তারা ছিল। তবে ৭ জানুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাবুল চাখারীর নেতৃত্বে একটি অংশ শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। অতীতে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন কিংবা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে থাকলেও পরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন বাবুল চাখারী।

অবশ্য বাবুল চাখারীর স্ত্রী নাজমা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী হয়রানির শিকার। আমরা ২০–দলীয় জোটের শরিক দল। অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের দিনও আমার স্বামী বঙ্গভবনে দাওয়াত পেয়েছিলেন। পরে আমার স্বামীকে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সেই থেকে আমার স্বামী কারাগারে। জামিন পেলেও আবার নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।’