সেলিম জাহিদ ঢাকা
![]() |
রংপুর শহরের ঈদগাহ ময়দানে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশ। ২৯ অক্টোবর ২০২২ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল লন্ডন বৈঠকের পর সেটা কেটেছে বলে মনে করা হচ্ছিল; কিন্তু দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই নতুন করে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংশয় তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। বিশেষ করে ভোটের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট কোনো বার্তা না দেওয়ায় এ নিয়ে জল্পনাকল্পনা বাড়ছে।
বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, লন্ডন বৈঠকের কোনো প্রতিফলন নির্বাচনের কমিশনের কার্যক্রম তারা দেখছেন না। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনসহ কিছু বিষয় নতুন করে সামনে আনার চেষ্টা হচ্ছে। এটাকে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান বলে মনে করছে বিএনপি।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। তাঁরা দীর্ঘ সময় একান্তে কথা বলেন। বিএনপির নীতি–নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ধারণা করেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার যমুনায় এই বৈঠকে সিইসিকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর কথা বলবেন; কিন্তু সরকারের দিক থেকে এই বৈঠককে শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হয়েছে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনও কোনো বক্তব্য দেয়নি। ফলে বিএনপি মনে করছে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়ে সিইসিকে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেননি। যার ফলে প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসির সাক্ষাতে কী আলাপ হয়েছে, তা পরিষ্কার করার আহ্বান জানায় বিএনপি। এ বিষয়ে গত শুক্রবার বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যদি উভয় পক্ষ থেকে জাতির সামনে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়, তাহলে আমরা আশ্বস্ত হই।’
যারা স্থানীয় নির্বাচন ও আনুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবি তুলছে, তাদের একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে; হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা অথবা নির্বাচন না হওয়া।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবারের ওই সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংস্কারপ্রক্রিয়া কতটা এগিয়েছে এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে সিইসির কাছে জানতে চেয়েছেন। তবে কবে নাগাদ নির্বাচন আয়োজন করা হতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো আলোচনার কথা জানা যায়নি।
১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সব প্রস্তুতি শেষ করা গেলে ২০২৬ সালে পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁদের কাছে এখন পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে লন্ডন বৈঠকের ওই ঘোষণার কোনো প্রতিফলন নেই; বরং রাজনীতিতে নতুন নতুন কিছু ইস্যু তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, যা জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান বলে মনে করছেন। এর মধ্যে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা এবং আগামী নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (পিআর) পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি জোরদার করা হচ্ছে।
![]() |
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বর্তমান ইসি বাতিলের দাবি এবং রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ ও জাতীয় পাটিকে (জাপা) নিষিদ্ধ করার দাবিও আবার সামনে আনা হতে পারে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা।
মৌলিক সংস্কার, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবিতে গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছে ইসলামী আন্দোলন। এতে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ, খেলাফত মজলিসের দুই ভাগসহ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পক্ষের দলগুলোর নেতারা আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিয়েছেন। তবে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘বিএনপি তো সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির বিপক্ষে। সে কারণে আমরা তাদের আমন্ত্রণ জানাইনি।’
যদিও বিএনপি আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন, রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ এ সব দাবির সঙ্গে একমত নয়। দলটি মনে করে, এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই। আর আনুপাতিক হারে নির্বাচন একটি জটিল প্রক্রিয়া। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গতরাতে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘যারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং আনুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবি করছে, এটা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান হতে পারে; কিন্তু সেটা আমাদের সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো বিষয় নয়। এটা অবিবেচনাপ্রসূত।’ তিনি বলেন, ‘যারা যারা স্থানীয় নির্বাচন ও আনুপাতিক হারে নির্বাচনের মতো এসব দাবি তুলছে, তাদের একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে, হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা, অথবা নির্বাচন না হওয়া। এ বিষয়গুলো আমাদের কাছ মনে হয়েছে।’
বিএনপির নীতি–নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও একটা জটিলতার আশঙ্কা করছেন। এর মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটি ঐক্যের পথে থাকলেও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলো এখনো একমত হয়নি।
বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করছেন, সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র এনসিপি বা তাদের সমমনাদের মতো করে তৈরি করতে পারে। গত ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছে। এর বাইরে সরকার কিছু করলে বিএনপি তাতে একমত হবে না। এমন কিছু হলে এ নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হতে পারে, যা জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে তিনি কোনো সংশয় দেখেন না। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে চলবে এবং চলতে হবে। এ নিয়ে কারও খেলাধুলা করার সুযোগ নেই। যারা গণতন্ত্রের পথে বাধা দেবে, জাতীয় নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করবে, তারা গণতন্ত্রের শত্রুতে পরিণত হবে।’
সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা চলছে। এ পর্বে ছয় দিনের আলোচনায় দেখা গেছে, সাংবিধানিক সংস্কার প্রশ্নে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ খেলাফত মজলিসের দুই অংশের অবস্থান অনেকটাই কাছাকাছি। এর মধ্যে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, জমিয়ত ও খেলাফত মজলিসসহ ২৩টি দল নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদের উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন চায়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনেরও পক্ষে দলগুলো। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিতেও এ দলগুলোর অবস্থা কাছাকাছি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন দলগুলোর মধ্যে একটি বৃহত্তর নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টা চলছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থাকছে না, এমনটা ধরে নিয়ে ডানপন্থী রাজনীতিতে যে নতুন মেরুকরণের চেষ্টা চলছে, তারই অংশ হিসেবে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টা চলছে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মোকাবিলায় আগামী নির্বাচনে একে অন্যকে আসনভিত্তিক ছাড় দেবে, এমন চিন্তা নিয়ে দলগুলোর নেতারা অগ্রসর হচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, যেহেতু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, তাই দলটির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে। এখন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নেবে কি না, দলটি অংশ না নিলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কি না; এমন কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এ ছাড়া বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যদি সরকার গঠন করে তাহলে বিরোধী দল কারা হবে, সেটারও স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। এই বিষয়গুলোকে ঘিরেই এখনকার রাজনীতি আবর্তিত বলে মনে করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের যদি ভিন্ন চিন্তা থাকে, তাহলে এ বিষয়গুলো অল্প সময়ের মধ্যে মাঠে আসতে পারে। সে লক্ষ্যে একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হতে পারে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর ও করিডরসহ জাতীয় নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়েও বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা আছে। যা নির্বাচন বিঘ্নিত করতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের অনেকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আসছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা ধরে রাখতে পারি কোনো বড় রকমের দুর্ঘটনা না হলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। যেহেতু এটার কমিটমেন্ট হয়ে গেছে। বড় রকমের দুর্যোগ না হলে আমি এতে সমস্যা দেখি না। সে ক্ষেত্রে দলকে দৃশ্যমান রাখার জন্য এবং সরকারকে চাপে রাখার জন্য বিএনপির নেতারা অনেক কথাই বলবে, এগুলো একধরনের রাজনৈতিক কৌশল।’