রোগীর হাতের ভেতরের অংশে তীব্র চুলকানি ও লালচে দাগ দেখা যাচ্ছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

ঘনবসতি, সচেতনতার অভাব ও ভুল চিকিৎসার কারণে চুলকানিজনিত রোগ খোসপাঁচড়া এখন ‘নীরব মহামারি’র রূপ নিচ্ছে—এমনই আশঙ্কা চিকিৎসকদের।

তারা বলছেন, প্রতিদিন হাসপাতালে আসা রোগীদের বড় একটি অংশ এ রোগে আক্রান্ত। সাম্প্রতিক সময়ে সংক্রমণের হার দ্বিগুণ হয়েছে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শাহনাজ আক্তার সাত দিন ধরে তীব্র চুলকানিতে ভুগছেন। বুধবার তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগে চিকিৎসা নিতে যান।

শাহনাজ বলেন, 'সারা শরীরে চুলকানি হচ্ছে, বিশেষ করে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। লালচে গোটা উঠেছে, রাতে বেশি চুলকায়। চুলকাতে আরাম লাগে, কিন্তু অনেক সময় রক্ত বের হয়। ভালো না হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শ নিতে এসেছি। বাসার সবাইকে ওষুধ মাখতে বলা হয়েছে।' 

হাসপাতালে দেখা গেল নাখালপাড়ার বাসিন্দা দুলাল শেখকে। দুই মাস ধরে তিনি চুলকানিতে ভুগছেন। শুরুতে তিনি আক্রান্ত হন, পরে তাঁর স্ত্রীও সংক্রমিত হন। যদিও তিনি মূলত হাঁটুর ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন, পরে তাঁকে চর্মরোগ বিভাগে পাঠানো হয়।

দুলাল জানান, 'শরীরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে ভাঁজে ভাঁজে চুলকানি হচ্ছে। দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়েছিলাম, প্রথমে কিছুটা উপশম হয়েছিল, কিন্তু পুরোপুরি সারে না। এবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছি।' 

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহেদ পারভেজ বলেন, 'প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১২০০ থেকে ১৫০০ রোগী আসছেন। তাঁদের প্রায় ৭০ শতাংশেরই সমস্যা খোসপাঁচড়া।'

তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে এটি এক ধরনের নীরব মহামারি। প্রায় প্রতিটি ঘরে কেউ না কেউ আক্রান্ত। কিন্তু সবাই স্বীকার করেন না। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি খুব দ্রুত ছড়ায়, তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে।' 

এই চিকিৎসক বলছেন, 'রোগী যত বেশি চুলকান, ততই সাময়িক আরাম পান, তবে ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এতে ‘সেকেন্ডারি ইনফেকশন’ হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুঁজ বা ফোঁড়া দেখা যায়। চুলকানি সাধারণত আঙুলের ফাঁকে, শরীরের ভাঁজে, নাভি, জয়েন্ট ও যৌনাঙ্গের চারপাশে বেশি হয় এবং রাতের বেলায় তা বেড়ে যায়। প্রথমদিকে আক্রান্ত অংশে জ্বালাপোড়া ও উত্তাপ বাড়ে।'

ডা. জাহেদ বলেন, 'খোসপাঁচড়া একাধিকবার হতে পারে। এটি নির্ভর করে ব্যক্তির জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর। দুর্বল স্যানিটেশন বা স্বাস্থ্যবিধি না মানলে রোগটি বারবার হতে পারে। কেউ কেউ পাঁচ-ছয়বার আক্রান্ত হয়েছেন।' 

তিনি আরও বলেন, 'পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, প্রতিদিন গোসল করা, বাসায় কেউ আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া এবং প্রয়োজন হলে তাঁকে আলাদা রাখা উচিত।' 

সহকারী অধ্যাপক ডা. মোর্শেদুল ইসলাম সজীব বলেন, 'রোগীরা সঠিকভাবে ওষুধ ব্যবহার করেন না, চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করে মাঝপথে ছেড়ে দেন—ফলে একজন থেকে অনেক জন আক্রান্ত হন। মাত্র ১৫ মিনিটের সংস্পর্শেই রোগ ছড়াতে পারে।' 

তাঁর মতে, 'সঠিক চিকিৎসা নিলে ১২ ঘণ্টার মধ্যেই উপশম সম্ভব এবং রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনাও থাকে না। আগে শীতকালে রোগটি বেড়ে যেত, এখন সারা বছরই ছড়িয়ে পড়েছে। মেস, মাদ্রাসা, হল—এমন স্থানে সংক্রমণ বেশি। এমনও রোগী আছেন যাঁদের কোনো উপসর্গ নেই, কিন্তু তারাও জীবাণু বহন করছেন।

তাঁর পরামর্শ, 'একটি বাসায় একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের সকল সদস্যের চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। 'একজন ওষুধ না মাখলে, তাঁর দেহে জীবাণু থেকে যায়। পরে অন্যদের আবার সংক্রমণ হতে পারে।' 

চিকিৎসা না নিলে খোসপাঁচড়া জটিল আকার নিতে পারে বলে জানান তিনি। 'ত্বকে একজিমা দেখা দেয়, শিশুদের ক্ষেত্রে কিডনিতে সংক্রমণ হতে পারে। বড়দের মধ্যেও কিডনি সমস্যা দেখা যেতে পারে।' 

তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, 'কারও আঙুলের ফাঁকে, যৌনাঙ্গে বা শরীরের ভাঁজে চুলকানি হলে, বিশেষ করে রাতে তা বাড়লে, দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। চিকিৎসার সময় শুধু রোগী নন, একই বাসায় থাকা সবাইকে ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, কাপড়চোপড় গরম পানিতে ধুয়ে নিতে হবে এবং পরিষ্কার বিছানাপত্র ব্যবহার করতে হবে। বাইরে কোথাও রাত্রিযাপন করলে শয্যার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন থাকার আহ্বান জানান চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, সচেতনতা ও চিকিৎসা—এই দুই মাধ্যমেই খোসপাঁচড়া প্রতিরোধ সম্ভব।'