নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

রাষ্ট্রের বি‍ভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এটি কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা। এর আগে প্রথম পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে দুই মাস সময় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেছিল কমিশন। প্রথম পর্বে যেসব মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য হয়নি সেগুলোর বিষয়ে এই পর্বে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

দ্বিতীয় পর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের এখন পর্যন্ত পাঁচ দিন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়েছে। এর আগের পাঁচ দিনে আলোচনা হয়েছে ৯টি বিষয়ে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। আগামীকাল বুধবার আবার আলোচনা হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, দ্বিতীয় পর্বে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলগুলোর সঙ্গে মোট ২০টির মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করার প্রস্তুতি আছে। তবে কমিশন এই সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। আলোচনায় অগ্রগতি সাপেক্ষে প্রয়োজনে আরও বিষয় যুক্ত করা হবে।

গত পাঁচ দিনে নয়টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেগুলো হলো— সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা, ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোট, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল (এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কত সময় প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন) এবং সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি।

এর মধ্যে প্রথম দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এর বাইরে কিছু ক্ষেত্রে আংশিক ঐকমত্য হয়েছে। তবে বাকি বিষয়গুলো আলোচনার টেবিল থেকে এখনো বাদ দেওয়া হয়নি। সেগুলো নিয়েও ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা অব্যাহত আছে, আরও আলোচনা হবে। এই আলোচনা কত দিন চলবে তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করার লক্ষ্য রয়েছে কমিশনের। অবশ্য ইতিমধ্যে কোনো কোনো দলের মুখে এই আলোচনা নিয়ে হতাশা ফুটে উঠেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশান ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়। পরে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই ছয়টি কমিশনের প্রধানদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন সংস্কারের ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর কাছ থেকে ছক আকারে মত নেয়। এরপর ২০ মার্চ থেকে শুরু হয় দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনা। এটি চলে ১৯ মে পর্যন্ত। গত ২ জুন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার উদ্বোধন করেন।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, কিছু সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে করার প্রস্তাবে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। দুই দিন আলোচনার পর এ দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়।

৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন সংসদ সদস্যরা।

দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা (এমপি) পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন বা স্বাধীন থাকবেন।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের আরেকটি প্রস্তাব ছিল, সবগুলো সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে করা হবে। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, সরকারি হিসাব, অনুমিত হিসাব, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ অধিকার–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি—এই চারটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ আসনের সংখ্যানুপাতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে দেওয়া হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলগুলো সংসদে যে কটি আসন পাবে, তার অনুপাতে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ পাবে।

ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে এবং এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা যাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে না যায়, সে জন্য সংবিধানে যেসব সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে, তার একটি হলো জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন। প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এনসিসি গঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি), পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ (পিএসসি) বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের নিয়োগের জন্য এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দেবেন।

বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। এনসিসি গঠন করা হলে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমবে।

জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ অনেক দল নীতিগতভাবে এ প্রস্তাবকে সমর্থন করে। তবে এনসিসির গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা আছে।

অন্যদিকে বিএনপি, সিপিবি, গণফোরাম, বাসদসহ কিছু দল এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নয়। বিশেষত এনসিসি নিয়ে বিএনপির জোরালো আপত্তি আছে। তারা মনে করে, এনসিসি গঠন করা হলে প্রধানমন্ত্রী পদের গুরুত্ব কমে যাবে। সরকার হবে দুর্বল।

সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আলোচনায় নতুন প্রস্তাব আসে। তা হলো—এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন। এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ বেশির ভাগ দল একমত। তবে বিএনপি, বিএলডিপি ও এনডিএমের আপত্তি আছে। এটি নিয়ে আরও আলোচনা হবে।

অবশ্য এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি কত দিন থাকবেন তার একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। তবে বিএনপি মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্ধারণ করে দেওয়ার সঙ্গে এনসিসি গঠন হচ্ছে কি না, সংসদের উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কী হবে—এসব বিষয়ও সম্পর্কিত। তাই সবগুলো প্রস্তাব একসঙ্গে প্যাকেজ আকারে আলোচনা করার পক্ষে দলটি।

সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সংসদ বা আইনসভাকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাব করেছে। এ ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষে ভোট হবে বিদ্যমান পদ্ধতিতে। আর উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসনের। নিম্নকক্ষে একটি দল সারা দেশে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে।

সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করা এবং উচ্চকক্ষে ১০০ টি আসন করার বিষয়ে বেশিরভাগ দল একমত। তবে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে অনেক মতভিন্নতা আছে। এনসিপি উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত নির্বাচনপদ্ধতির সঙ্গে একমত। তারা চায় উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা আগেই প্রকাশ করা হোক। অন্যদিকে বিএনপি চায় নিম্নকক্ষে একটি দল যতগুলো আসন পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে। আর জামায়াতে ইসলামী সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচন আনুপাতিক পদ্ধতিতে করার পক্ষে।

অবশ্য কোনো কোনো দল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করার বিপক্ষে। তারা মনে করে এতে ‘মাথাভারী’ হবে।

সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ১০০টি করা এবং এসব আসনে সরাসরি ভোট দেওয়ার প্রস্তাব করেছে সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। দুই দফা আলোচনায় আসন ১০০টি করার বিষয়ে মোটামুটি ঐকমত্য হলেও নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এখনো মতভিন্নতা আছে।

প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করার বিষয়ে ঐকমত্য আছে। তবে নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছুটা মতভিন্নতা আছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাব করেছে। দলগুলো এখানে বিকল্প রাখার (জ্যেষ্ঠ দুই বা তিনজন থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি করা) পক্ষে।

রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন নিয়েও এখনো ঐকমত্য হয়নি। সংসদ উভয় কক্ষের সদস্যের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন—সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবের সঙ্গে অনেক দল একমত নয়।

সংবিধানের মূলনীতি প্রশ্নেও মতভিন্নতা রয়েছে। এখানে মোটাদাগে বামপন্থী দলগুলো একদিকে আর ধর্মভিত্তিক দলগুলো আরেক দিকে।

যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, তাতে কতটা ঐকমত্য হবে তা নিয়েও সংশয়ের কথা এসেছে। গত রোববার গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেকগুলো বিষয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে একমত হচ্ছি আমরা। কিন্তু এখানে কিছু কিছু দল একবারে নিজেদের অবস্থানে অনড়। যদি এভাবে চলতে থাকে কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্যের সম্ভাবনা দেখি না।’

আবার ঘুরেফিরে একই বিষয় একাধিকবার আলোচনায় আসছে। গত রোববারের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ছয়টি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। ঘুরেফিরে একই আলোচনা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কতটি দল কোনো বিষয়ে একমত হলে সেটা ঐকমত্য হবে। তাঁরা আলোচনায় সময় দেবেন, কিন্তু এর একটা ফল থাকতে হবে, একটা সময় নির্ধারিত থাকতে হবে।

অনেকে মনে করছেন দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা হলেও সে অনুযায়ী ফল আসছে না। যেমন গত বৃহস্পতিবার আলোচনা শেষে এবি পার্টি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু সাংবাদিকদের বলেন, তিন দিন ধরে ব্যাপক আলোচনা-বিশ্লেষণ চলছে, কিন্তু কোনো বিষয়েই ঐকমত্য হচ্ছে না।