লেখা: কবীর আলমগীর

অহমদ ছফা (১৯৪৩–২০০১) ছবি: বিপ্লব চক্রবর্তী

৩০ জুন জন্ম নিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের অন্যতম চিন্তাবিদ, লেখক ও প্রতিবাদের প্রতীক। তাঁর পরিচয় বহুমাত্রিক—তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক চিন্তক। আহমদ ছফাকে শুধু ‘প্রাবন্ধিক’ বললে তাঁর গভীরতা, ব্যাপ্তি ও প্রভাবকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। তিনি ছিলেন সেই দুর্লভ বাঙালি, যিনি এক হাতে বই লিখতেন আর অন্য হাতে দেশের বিবেক জাগিয়ে তুলতেন।

ছফার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল যুক্তিনির্ভরতা ও বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতা। তিনি ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এবং অন্ধ আনুগত্যের বিরুদ্ধে ছিলেন সর্বদা সচেতন। তাঁর মতে, জাতিকে যদি জাগ্রত করতে হয়, তবে আগে জাগাতে হবে চিন্তার স্বাধীনতা। একটি সমাজ তখনই বিকশিত হয়, যখন সেখানে মতপ্রকাশের অধিকার থাকে, মতভেদকে সম্মান করা হয় এবং বিতর্ককে অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়। সুতরাং ছফার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রয়োজন একটি যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার পরিবেশ। পাঠ্যক্রমে মুক্তচিন্তা, যুক্তি ও দর্শনের চর্চা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও ভিন্নমতকে দমন নয়, বরং উৎসাহ দিতে হবে। আজকের তরুণ প্রজন্ম যদি প্রশ্ন করতে শেখে, তবে ছফার পথেই তারা হেঁটে চলেছে।

আহমদ ছফা এমন এক বাংলাদেশ কল্পনা করেছিলেন, যা হবে মানুষের, মানবতার, ন্যায়ের ও সংস্কৃতির। তাঁর লেখায় শুধু সাহিত্যের সৌন্দর্য নয়, ছিল রাষ্ট্রচিন্তার বিশ্লেষণ, ইতিহাসের নির্মোহ পুনর্মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণের দিকনির্দেশ। ছফার ভাবনায় ছিল রাষ্ট্র কেবল ভূগোল নয়, এটি এক আত্মিক প্রকাশ। ছফা যে বাংলাদেশ কল্পনা করতেন, সেখানে রাষ্ট্র হবে জনগণের। দল নয়, ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী নয়, বরং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তা থাকবে সেই রাষ্ট্রে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে রাজনীতি যেভাবে ব্যক্তি ও দলের সংকীর্ণতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে, তা ছফার আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সাংবিধানিক সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকা। ছফা চাইতেন রাজনীতির কেন্দ্রে থাকুক নীতির প্রশ্ন, আদর্শের প্রশ্ন, মানবিকতার প্রশ্ন। এই চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত সব জায়গায় আদর্শিক মানদণ্ড ফেরত আনতে হবে।

আহমদ ছফার সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা ছিল—স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, কীভাবে অনেক বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি আমলে ক্ষমতার পদলেহন করেছেন, আর স্বাধীনতার পর সেই একই পন্থায় বেঁচে থেকেছেন। তিনি বলেছিলেন: এই জাতির সবচেয়ে দুর্ভাগ্য এই যে তাদের যারা বুদ্ধিজীবী, যারা চিন্তার দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা অধিকাংশই মেরুদণ্ডহীন। ছফার মতে, যদি জাতির চিন্তানেতৃত্ব ব্যর্থ হয়, তবে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার বা মানবিকতা—কোনো কিছুরই বিকাশ সম্ভব নয়। একটি জাতির ‘বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুদণ্ড’ ভেঙে গেলে জাতি হয়ে পড়ে দিশাহীন। একদিকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অন্যদিকে চিন্তার পঙ্গুত্ব—এই দুইয়ের সম্মিলনে জাতি ধীরে ধীরে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। এই উক্তি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। যখন চিন্তাবিদেরা দলকানা হয়ে পড়েন, সত্যকে এড়িয়ে যান, অথবা ভয়ে চুপ থাকেন—তখন ছফার এই উচ্চারণ যেন ঘনঘোর সতর্কবার্তা হয়ে ফিরে আসে। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশেও নৈতিক নেতৃত্বের অভাব, একচেটিয়া ভাবনাচর্চা এবং মতপ্রকাশের সংকট এই সমস্যারই প্রকাশ।

ছফা চাইতেন এক সাহসী বুদ্ধিজীবী সমাজ, যারা সত্য বলবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং রাষ্ট্রের বিবেক হয়ে কাজ করবে। এ ধরনের সমাজ গড়তে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হতে হবে স্বাধীন চিন্তার অগ্রভাগ। লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী—এঁদের দায়িত্ব নিতে হবে সমাজকে নৈতিকভাবে জাগিয়ে তোলার। নৈতিকতা ছাড়া জ্ঞান যেমন অন্ধ, তেমনি ছফার বাংলাদেশও অসম্ভব।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চাকে ছফা দুটি দলে চিহ্নিত করেছেন—এক দলে আছেন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে উৎপীড়িত ও লাঞ্ছিত মানুষ, অপর দলে আছেন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দুদলের রুচি ও ধরন আলাদা।...সমাজ ও সংস্কৃতির মতো ভাষাও বাংলাদেশের সমাজবদলের হাতিয়ার হিসেবে অবদান রাখতে পারে বলে ছফা বিশ্বাস করতেন। তাই ভাষার সক্ষমতা অর্জনকে ছফা সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। ঔপনিবেশিক সমাজকাঠামো ঔপনিবেশিক আর্থকাঠামোরই সৃষ্টি এবং ভাষাদেহেও সেই ঔপনিবেশিক নির্ভরতা প্রবহমান। উপনিবেশিতের সংস্কৃতির ওপর উপনিবেশক যে আধিপত্য বিস্তার করে, ভাষাই সে চিহ্ন বহন করে থাকে। তাই একযোগে ভাষার সব কটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে ঔপনিবেশিকতা তথা দাসত্বের চিহ্নগুলো মুছে ফেলাই স্বাধীন জাতির প্রথম কর্তব্য। এটিও একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সুবর্ণরেখা। যেখান থেকে পুরো সমাজ এবং অর্থনীতির খোলনলচে বদলে দিয়ে এক নতুন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির উত্থান ঘটবে।

বাঙালি মুসলমান হিসেবে আত্মপরিচয়ের সংকট দূর করতে হলে ছফার দেখানো পথে ফিরতে হবে। আমাদের ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য—এই উপাদানগুলোর মধ্যেই রয়েছে আমাদের জাতিসত্তা। এই আত্মপরিচয়কে ভিত্তি করেই তৈরি করতে হবে একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ, যেখানে ‘বাঙালি’ পরিচয় গৌরবের ও একতাবদ্ধ হওয়ার শক্তি হবে। আহমদ ছফা বিশ্বাস করতেন, উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা ও সংস্কৃতি। তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাকে মানবিক ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। পাঠ্যবই থেকে শুরু করে পাঠদর্শন পর্যন্ত ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু তথ্য নয়, মানুষ গড়ার শিক্ষা দরকার। পাশাপাশি সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় উৎসাহ দিতে হবে মুক্তচিন্তা, সৃজনশীলতা ও সাহসী প্রকাশকে।

আহমদ ছফা কখনো সংখ্যাগুরু চিন্তাধারার অংশ হননি। তিনি ছিলেন সেই বিরল লেখক, যিনি বরাবর শোষিত মানুষের পক্ষে কলম ধরেছেন। সাহিত্যে, সাংবাদিকতায় কিংবা বক্তৃতায়—সব জায়গায় তাঁর অবস্থান ছিল অবিচল ও আপসহীন। তিনি বিশ্বাস করতেন, লেখকের কাজ শুধু সাহিত্য রচনা নয়, বরং সময়ের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। এই কারণেই তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শোষিতের প্রতি সহমর্মিতা এবং বাংলাদেশি জাতিসত্তার জাগরণ। আহমদ ছফার সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ এবং ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। এই দুই গ্রন্থে তিনি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বাঙালির জাতিসত্তা ও মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনস্তত্ত্ব। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে পাকিস্তানি আমলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থে কাজ করেছেন, কীভাবে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছেন। তাঁর লেখা কোনো দল বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নেয়নি, বরং সব ধরনের পক্ষপাতিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

১৯৭২ সালে গণকণ্ঠে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলে তা সাহিত্য সমাজে ভূকম্পনের মতো অভিঘাত হানে। সরকার, বুদ্ধিজীবী, এমনকি লেখক সমাজ—সবাই তাঁর কলমের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দ। কারণ, তিনি তুলে ধরেন সেই অপ্রিয় সত্য, যা সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। যুবক বয়সে আহমদ ছফা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলার মতো বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপনে যান। এই জীবনধারা পরবর্তী সময়ে তাঁর চিন্তায়, লেখায় ও মননে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তাঁর বন্ধু ও সমকালীন লেখকেরা যখন সুবিধাবাদিতা, পদক-পদবির পেছনে ছুটেছেন, তখন ছফা ছিলেন উল্টো পথে হেঁটে যাওয়া এক সাহসী মানুষ।

আহমদ ছফা ছিলেন ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক অবিচল কণ্ঠ। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে সমাজের গোঁড়ামি ও রাজনৈতিক শঠতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান। তিনি কখনো ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বাইরে সমাজ নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি। তাঁর মতে, জাতি গঠনের মূল ভিত্তি হতে হবে মুক্তচিন্তা, মানবতাবাদ ও সাংস্কৃতিক চেতনা। আহমদ ছফা অনুধাবন করেছিলেন: যারা বাংলাদেশের সর্বমানবের জীবনের মঙ্গলের মতো একটি প্রাণোচ্ছল সংস্কৃতি কামনা করেন, তাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে পিঠাপিঠি ভাইবোনের মতো দেখা ছাড়া উপায় নেই। কেননা, রাজনীতিতে যদি ফ্যাসিবাদ শিকড় গেড়ে বসে, সাংস্কৃতিক অগ্রসরণের প্রশ্নই ওঠে না। সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক অগ্রগতি নেই। রাজনীতি সুন্দরভাবে, সুস্থভাবে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে বাঁচার সংগ্রাম।’ আহমদ ছফার সাহিত্যচর্চা ছিল তাত্ত্বিক, অথচ জীবনঘনিষ্ঠ। তাঁর উপন্যাস অলাতচক্র, গাভী বিত্তান্ত কেবল সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র বিশ্লেষণের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তাঁর ভাষা সহজ, অথচ বিষয়ের গভীরতা অতল। তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন, যেখানে দুর্বল, প্রান্তিক, নিপীড়িত মানুষের জীবন কথা বলে।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণ–অভ্যুত্থান শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতীক নয়; এটি ছিল দীর্ঘদিনের দুঃশাসন, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা এক তরুণ প্রজন্মের সাহসী পদক্ষেপ। এই আন্দোলন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের অন্যতম চিন্তাবিদ আহমদ ছফার স্বপ্ন, যিনি আজীবন এক গণতান্ত্রিক, মানবিক ও ন্যায়ের রাষ্ট্র নির্মাণে কলম চালিয়েছেন। আহমদ ছফা মনে করতেন, একটি জাতির প্রকৃত শক্তি নিহিত থাকে তার তরুণদের মধ্যে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে এক চিন্তাশীল, মানবিক ও প্রতিবাদী প্রজন্ম। ছফার স্বপ্ন ছিল একটি এমন বাংলাদেশ, যেখানে রাষ্ট্র হবে মানুষের জন্য, দলের জন্য নয়। তিনি বারবার সতর্ক করেছিলেন রাজনৈতিক দলান্ধতা, ধর্মান্ধতা ও সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি সমাজ, যেখানে শিল্প-সাহিত্য ও শিক্ষা হবে উন্নয়নের ভিত্তি, আর যেখানে তরুণেরা বিকশিত হবে মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ ও নৈতিক সাহসে। আহমদ ছফা উচ্চকিত করেছেন মানুষের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার চেতনাকে। আহমদ ছফা লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের সর্ব মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার এখন অপরিহার্য সামাজিক প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্ঞান এবং যুক্তির আলোকে এযাবৎকাল ধরে ধর্মীয় কুসংস্কার এবং সমাজের প্রাণহীন আচার সংস্কারগুলো কখনো বিচার করা হয়নি। কামাল পাশার তুরস্কের মতো বাংলাদেশেও অনেকগুলো মজ্জাগত ধর্মীয় সংস্কার জোর করে পিটিয়ে তাড়াতে হবে। শুধু হিন্দু মুসলমান সৌভ্রাতৃত্ব নয়, গারো, হাজং, চাকমা, মগ যেসব অধিবাসী আছেন, যেসব উর্দুভাষী থেকে যাবেন, তাদেরকে পুরোপুরি মানবিক মর্যাদা দিতে হবে। মানুষকে সত্যিকারভাবে মর্যাদা না দিয়ে মানুষের কোন শ্রদ্ধেয় সমাজ সৃজন সম্ভব নয়।’

আহমদ ছফার চেতনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন দায়িত্ববান নাগরিক, বিবেকবান নেতৃত্ব এবং সাংস্কৃতিক জাগরণ। ২০২৪-এর গণজাগরণ সেই চেতনাকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। যদিও আন্দোলনের পথ সহজ ছিল না—রক্ত ঝরেছে, প্রাণহানি ঘটেছে কিন্তু হার মানেনি তারুণ্য। এই অভ্যুত্থান শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের জন্যও একটি দিকনির্দেশনা। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ছফার মতো চিন্তাবিদদের কথা ভুলে গেলে জাতি দিক হারায়। তিনি যে মূল্যবোধের কথা বলেছিলেন—সচেতনতা, নৈতিকতা, সমতা, মানবিকতা, তা এখনো প্রাসঙ্গিক, বরং আগের চেয়ে আরও বেশি প্রয়োজনীয়। ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান আহমদ ছফার স্বপ্নের বাংলাদেশেরই এক অগ্রভাগ বলা যায়। এটি তরুণদের আত্মজাগরণ এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণের সংকল্প। যদি এই চেতনা বজায় থাকে, যদি তরুণেরা ছফার মতো আপসহীন সাহসিকতা নিয়ে এগিয়ে চলে—তবে নিশ্চিতভাবেই গড়ে উঠবে সেই বাংলাদেশ, যা হবে মানবতা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।

আহমদ ছফা ছিলেন একা, কিন্তু তাঁর কণ্ঠ ছিল লাখো মানুষের। তিনি সাহিত্যের প্রাসাদে বন্দী থাকেননি। তিনি মাঠে ছিলেন, মিছিলে ছিলেন, প্রতিবাদে ছিলেন। যখন চারপাশের মানুষ নিশ্চুপ, তখন তিনি উচ্চারণ করেছেন অপ্রিয় সত্য। আজ যখন আমরা তাঁর জন্মদিনে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্মরণ করি, তখন আমাদের নতুন করে ভাবা প্রয়োজন—আমরা কি ছফার স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মাণে সক্ষম হচ্ছি? ২০২৪-এর গণ–অভ্যুত্থান কি তাঁর দেখানো পথে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? আমরা যদি সত্যিই ছফাকে স্মরণ করতে চাই, তবে তা কেবল জন্মদিনে ফুল দিয়ে নয়, বরং সাহসী চিন্তা ও প্রতিবাদী চেতনায় তাঁর উত্তরসূরি হয়ে উঠতে হবে। কারণ, আহমদ ছফা একজনই—বাংলাদেশের সাহিত্যে, সমাজে, রাজনীতিতে এবং আত্মসন্ধানী আত্মায়।

আহমদ ছফার জীবন ছিল এক অর্থে বেদনার, অন্য অর্থে বীরের। তিনি ছিলেন এক বিপ্লবী সন্ন্যাসী—যিনি সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন, অথচ সেই সমাজই তাঁকে অনেক সময় বর্জন করেছে, ভুল বুঝেছে, একা করে দিয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি কখনো সংসার শুরু করেননি, অথচ মানুষকে ভালোবেসেছেন পিতার মতো। তরুণদের জন্য তিনি ছিলেন আশ্রয়, বন্ধু, শিক্ষক ও অভিভাবক। আহমদ ছফা প্রায়ই প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিক গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছেন। বিশেষত বাংলাদেশের লেখক, সম্পাদক ও শিক্ষাবিদ সমাজের অনেকের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব ছিল তীব্র। কারণ, তিনি সাহিত্যের ভেতরের সুবিধাবাদ, রাজনীতির সঙ্গে আপস এবং নীতিহীন সমঝোতা দেখে ক্ষুব্ধ হতেন। ফলে তিনি অনেক সময় ‘বিতর্কিত’ বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। তবে এই বিতর্কই তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। কারণ, তাঁর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সত্য বলার কারণে, তোষামোদ না করায়। সাহিত্যে যাঁরা চুপ থেকেছেন, ছফা তাঁদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারি, সেই সময়ের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কেই ছফা সঠিক ছিলেন। আহমদ ছফা শুধু অতীতের লেখক নন। তিনি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে শিক্ষিত তরুণদের দায়িত্ব, রাষ্ট্রকে বদলানোর প্রয়োজন এবং সাংস্কৃতিক জাগরণের ডাক।

আজকের তরুণ সমাজ যখন হতাশা, বৈষম্য, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের শিকার, তখন ছফার লেখা তরুণদের মনে জাগাতে পারে নতুন প্রতিবাদের সাহস। অনেকেই আহমদ ছফাকে কেবল সাহিত্যিক মনে করে ভুল করেন। আসলে ছফার প্রকৃত আগ্রহ ছিল ‘নৈতিক বিপ্লব’-এ। তিনি চেয়েছিলেন নৈতিক সাহসের এক নতুন সমাজ, যেখানে মানুষ সত্য বলবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে এবং ভোগের সমাজকে প্রত্যাখ্যান করবে। এই কারণে তাঁর সাহিত্য পাঠের সময় পাঠকের মন শুধু আলোকিত হয় না, খোঁচাও লাগে। তিনি ছিলেন আত্মমগ্ন নয়, সমাজমুখী লেখক। কেননা ছফা লেখার শেষ লক্ষ্য মনুষ্যত্বের বিজয়।

আহমদ ছফা লিখেছেন: ‘চরিত্রের যা কিছু মহৎ, শ্রেষ্ঠ এবং সত্য তার ওপর দাঁড়িয়েই বাঙালিরা ফ্যাসিবাদী পাকিস্তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের মানুষকে দাস করে রাখবার জন্য মানুষ যে জঙ্গলের আইন চালু করেছে। গত পঁচিশে মার্চ তারিখের পর থেকে সেই নৃশংস বনের আইন প্রয়োগ করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে খাঁচায় আটক রাখবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে তারা। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ পশুশক্তির দাস না থেকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে রণধ্বনি তুলেছেন। বস্তুত বাংলাদেশের এ সংগ্রাম প্রাগৈতিহাসিক পাকিস্তানি ডাইনোসরের বিরুদ্ধে সভ্য স্বাধীনতাকামী মানুষের মানুষী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। এই সংগ্রামের এসিড স্পর্শে বাঙালি মানসিকতার খুব দ্রুত পালাবদল ঘটেছে। পূর্বেকার সংস্কারের জের রণ রক্ত সফলতার মধ্য দিয়ে তার চেতনা থেকে বুড়ো পাতার মতো ঝরছে প্রতিদিন। আর বিশ্বের এতাবৎকালের মানবসমাজের সংগ্রামী অভিজ্ঞতার সারৎসার তার চেতনায় স্থান করে নিচ্ছে এবং নতুন মানুষ হয়ে উঠেছে প্রতিদিন। যেকোনো জাতির জন্য আদর্শবদ্ধ দুঃখের হিমশীতল স্পর্শের চাইতে মহৎ শিক্ষা আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ যারা লড়াই করেছেন, যারা ছিন্নমূল হয়ে শরণার্থী শিবিরে বাস করেছেন সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, হবেন। অনেকে প্রিয়জন বিসর্জন দিয়েছেন, দিচ্ছেন এবং দেবেন। বাঙালি জাতি সামগ্রিকভাবে এমন ত্যাগ, এমন আত্মবিসর্জন ইতিহাসের আর কোনো পর্যায়ে করেনি। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই আত্মবিশ্বাসের মরচে প্রচণ্ড বাস্তব আঘাতের মুখে ঝরছে এবং চরিত্রের যা সত্যিকার শক্তি বা সৃষ্টিশীলতায় বিকাশ লাভ করছে। এই লড়াই প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিয়ে বাংলার ইতিহাসের ভারকেন্দ্রে ঢালাই হওয়া মানুষদের সমাজ থেকে বাংলার পাললিক মৃত্তিকার আসল সন্তানদের সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে। বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় আসন্ন হয়ে উঠেছে, তার স্থপতি বাংলার সাধারণ জনসাধারণ। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, নারী পুরুষ, লেখক, শিল্পী এবং সর্বস্তরের মানুষ।’

আহমদ ছফার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেছেন: আহমদ ছফাকে নিছকই সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণনা করলে মারাত্মক গলতি হওয়ার সম্ভাবনা। তাঁর জীবনযাপন, সামাজিকতা, লেখালেখি, রাজনীতি, তরুণদের দুর্দান্ত প্রেরণায় উজ্জীবিত করার ক্ষমতা—ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর তাৎপর্য অন্য রকম। তাঁর সাহিত্য ও অপরাপর চর্চা তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের গৌণ দিক, প্রধান দিক নয়। আহমদ ছফা অন্য জিনিস। আহমদ ছফা বাংলাদেশে একটি ঘটনা। অতএব আহমদ ছফার জীবনদর্শন একটি জাতির আত্মপরিচয় রক্ষায় নৈতিকতা ও সত্যবাদিতার প্রতি অটল থাকা, সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ, এবং স্বাধীনচেতা চিন্তার অবিচল প্রয়াসের ওপর গুরুত্বারোপ করে। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে জাতির মুক্তি ও উন্নতি শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের জাগরণের মধ্য দিয়েই সম্ভব।