প্রতিনিধি কুমিল্লা
কুমিল্লার মুরাদনগরে আলোচিত ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি ফজর আলীর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে একধরনের ‘ঠেলাঠেলি’ শুরু হয়েছে। ঘটনার পর থেকে কেউ তাঁকে আওয়ামী লীগ আবার কেউ তাঁকে বিএনপির লোক বলে অভিহিত করছেন। তবে কোনো দলেই তাঁর পদ থাকার তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদিও এলাকায় সুবিধাবাদী হিসেবে পরিচিত ফজর আলীর দুই দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই অংশ নেওয়ার বেশ কিছু ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
কুমিল্লার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, একজন ধর্ষণকারী বা অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে না। ফজর আলীর দলীয় পরিচয় নিয়ে যেভাবে টানাহেঁচড়া শুরু হয়েছে, তা নোংরা রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ।
গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে মুরাদনগর উপজেলার একটি গ্রামে বসতঘরের দরজা ভেঙে এক নারীকে (২৫) ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ফজর আলীর বিরুদ্ধে। ধর্ষণের বিষয়টি টের পেয়ে আশপাশ থেকে কিছু লোক এসে ফজর আলীকে পেটাতে থাকেন। এ সময় ওই নারীকেও বিবস্ত্র অবস্থায় মারধর করেন স্থানীয় কয়েকজন যুবক। যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরই মধ্যে ধর্ষণ এবং বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় থানায় দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। হাত-পা ভেঙে ফেলার কারণে ফজর আলী বর্তমানে পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সরেজমিনে এলাকায় ফজর আলীর রাজনৈতিক পরিচয় জানার চেষ্টা করা হলে কোনো দলে পদ-পদবি থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগপর্যন্ত ফজর আলী এলাকা দাবড়ে বেড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে। আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীর সঙ্গে দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের তাঁর অসংখ্য ছবি রয়েছে। ৫ আগস্টের পর ভোল পাল্টে নিজেকে বিএনপির লোক হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন তিনি। যেতেন বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও। গেল বছরের ১৪ ডিসেম্বর রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন বিএনপির কার্যালয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ছবিতেও তাঁকে দেখা গেছে।
![]() |
ফজর আলী | ছবি: সংগৃহীত |
স্থানীয় বাসিন্দারা ফজর আলীকে ‘সুবিধাবাদী দলের’ লোক হিসেবেই জানেন। মাদক ব্যবসা ও জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের সঙ্গে ফজর আলীর ছিল বেশ ঘনিষ্ঠতা।
এ প্রসঙ্গে জানতে ইউপি চেয়ারম্যানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি প্রথমে একটি সভায় রয়েছেন বলে জানান। পরে বেলা একটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ধরনেনি।
ফজর আলীর এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্যের ভাষ্য, ফজর আলী মূলত মাদক কারবারি ও জুয়ার সঙ্গে জড়িত। তাঁর জুয়ার আসরে গিয়ে এলাকায় অনেক মানুষ সব হারিয়েছেন। ফজর আলী সুবিধাবাদী টাইপের লোক। আগে আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অপকর্ম করেছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি নিজেকে বিএনপির লোক বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। বর্তমানে তিনি এলাকায় বিএনপির লোকজনের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। এর আগেও এলাকায় অনেক অপকর্ম করেছেন ফজর। মূলত তাঁর কাজই হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ব্যবহার করে অপকর্ম করা। ফজরের সঙ্গে তাঁর ভাই শাহ পরানের বিরোধ রয়েছে। ওই দিন রাতে যেসব পোলাপান এসে তাঁকে পিটিয়েছে, তাঁর ভাই ইন্ধন দিয়েই ওই সব পোলাপানকে এখানে পাঠিয়েছেন।
এমন নির্মম ঘটনার পর রাজনৈতিক দলগুলো যখন একে অন্যের দিকে দায় চাপানোর চেষ্টা করে, তখনই এই সুযোগ কাজে লাগায় অপরাধীরা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
ঘটনার পর থেকেই ফজর আলীকে বিএনপির কর্মী বলে প্রচার করে একটি পক্ষ। তবে ফেসবুকে বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে পোস্ট করে জানানো হয়েছে,‘মুরাদনগরে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাকে বিএনপি বানিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচার’ করা হচ্ছে। সর্বশেষ রোববার বিকেলে কুমিল্লা নগরের একটি পার্টি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে ‘আওয়ামী লীগ কর্মী ফজর আলীকে বিএনপি কর্মী বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে’ বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি।
বিএনপির অনুষ্ঠানে ছবি থাকা এবং এলাকায় ফজর আলী নিজেকে বিএনপির লোক পরিচয় দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন অঞ্জন বলেন, ৫ আগস্টের পর অনেকেই বিএনপিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন। কেউ বিএনপির লোক দাবি করলেই বিএনপি নেতা–কর্মী হয়ে যায় না। ফজর আলীর সঙ্গে বিএনপির ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। আর মুরাদনগরে বর্তমানে আওয়ামী লীগ মানে এনসিপি।
আত্মগোপনে থাকায় ফজর আলীকে নিয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগের কোনো নেতার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে রোববার তাঁকে নিয়ে আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে দাবি করা হয়, ‘১০ মাস ধরে নিজ এলাকায় সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফজর আলী। বিএনপি সমর্থিত দলবল নিয়ে প্রায়ই এলাকায় মোরাল পুলিশিং অপারেশন চালায় ফজর আলী। উক্ত ওয়ার্ডের বিএনপি সেক্রেটারি ক্যান্ডিডেট ফজর আলী...।’
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি অধ্যাপক নিখিল চন্দ্র রায় বলেন, অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে না। একজন ধর্ষণকারীর পরিচয় শুধুই অপরাধী। অতীতের ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এসব ঘটনার পরই অপরাধীর দলীয় পরিচয় নিয়ে একধরনের নোংরা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দলকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে, যা মোটেই কাম্য নয়। আইন তাঁর নিজের গতিতে চলবে, অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখার আশা প্রকাশ করে কুমিল্লার বিশিষ্ট নারীনেত্রী দিলনাশি মোহসেন বলেন, ‘এমন নির্মম ঘটনার পর রাজনৈতিক দলগুলো যখন একে অন্যের দিকে দায় চাপানোর চেষ্টা করে, তখনই এই সুযোগ কাজে লাগায় অপরাধীরা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যদিও আমাদের উচিত ছিল এসব অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় না খুঁজে তাদের সামাজিকভাবেও বয়কট করা।’
অপরাধীর দলীয় পরিচয় খুঁজে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে মনে করেন কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) এ কে এম কামরুজ্জামানও। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে অপরাধীদের পরিচয় শুধুই অপরাধী। আমাদের প্রয়োজন হয় না অপরাধীর দলীয় পরিচয়ের, এ জন্য আমরা এই ঘটনার পর কোনো অপরাধীর দলীয় পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করিনি। শুধু এই ঘটনাই নয়, যেকোনো ঘটনার ক্ষেত্রেই অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে টানাটানি করা মানে তাকে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া।’
শুরু থেকেই অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখা হচ্ছে উল্লেখ করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও বলেন, এরই মধ্যে মূল হোতাসহ ওই নারীকে নির্যাতন করে যারা ভিডিও ছড়িয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশবিক নির্যাতনের পরে নির্যাতন ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় আরও যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।