প্রতিনিধি শেরপুর
![]() |
শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে দ্বিতীয় দফায় চিকিৎসা দেওয়ার পর বনে ফিরে যাচ্ছে বন্য হাতি। ১৮ মে উপজেলার সমশ্চুড়া পাহাড়ের ঢাল থেকে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্তের গারো পাহাড়ের লোকালয়ে গত ১৫ এপ্রিল নেমে আসে ৪০-৪৫টি হাতির দল। সেই দলে ছিল একটি অসুস্থ হাতি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। সামনের ডান পা ফুলে থাকা হাতিটি একসময় দলছুট হয়ে পড়ে। বিষয়টি স্থানীয় একজনের নজরে আসে। তিনি এ নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেন।
বন্য হাতিটির চিকিৎসা করার সিদ্ধান্ত হয়। ২৭ এপ্রিল থেকে বন বিভাগের কর্মীরা দল বেঁধে এক টিলা থেকে আরেক টিলায় ঘুরে হাতিটিকে খুঁজতে থাকেন। ৩০ এপ্রিল বিকেলে কাটাবাড়ী এলাকার জঙ্গলে হাতিটিকে পাওয়া যায়। তখন খবর দেওয়া হয় গাজীপুর সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে। তিনি বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে সে দিন রাতেই মধুটিলা ইকোপার্ক কার্যালয়ে যান।
১ মে সকাল ১০টার দিকে কাটাবাড়ীতে একটি জলাশয়ের ধারে হাতিটিকে ঝিমাতে দেখা যায়। দূর থেকে ট্রানকুইলাইজার বন্দুক দিয়ে অচেতন করা হয়। এরপর শুরু হয় চিকিৎসা। আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে হাতিটির চিকিৎসা।
এই দলে ছিলেন গাজীপুর সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ল্যাব টেকনিশিয়ান আতিকুর রহমান ভূঁইয়া, ভেটেরিনারি সার্জন সাকিব হোসেন, সহকারী মোস্তফা কামাল, শেরপুর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. শাহিন কবির, বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুমন সরকার, ওয়াইল্ডলাইফ রেঞ্জার মো. আবদুল্লাহ আল আমিন, মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. দেওয়ান আলী এবং সমশ্চুড়া বিট কর্মকর্তা মো. কাউসার হোসেন।
চিকিৎসকেরা বলেন, ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী হাতিটির সামনের ডান পায়ে ধারালো অস্ত্রের পুরোনো ক্ষত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, দেড় থেকে দুই মাস আগে কেউ বল্লম জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করেছিল। সেই ক্ষতস্থানে পচন ধরেছিল। ক্ষত পরিষ্কার করে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, ব্যান্ডেজ করা হয়। পরে বিশেষ ইনজেকশন দিয়ে হাতিটিকে জাগিয়ে তোলা হয়। ২০-২৫ মিনিট পর হাতিটি জঙ্গলের ভেতরে চলে যায়।
অসুস্থ হাতিটি নজরে এসেছিল বন্য প্রাণিপ্রেমী স্থানীয় বাসিন্দা কাঞ্চন মারাকের। তিনি বলেন, গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রথম অসুস্থ হাতিটিকে দেখেন। তিনি সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেন। বিষয়টি বন বিভাগের নজরে আসে। বন বিভাগ দ্রুত অসুস্থ হাতিটির চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়।
দ্বিতীয় দফায় ১৭ মে রাতে আবারও বিশেষজ্ঞ দল মধুটিলা আসে। পরদিন সকালে ছয় ঘণ্টা ঘুরে বড়খোল জঙ্গলে হাতিটির অবস্থান পাওয়া যায়। আবারও অচেতন করে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
চিকিৎসকেরা বলেন, হাতিটির ক্ষতস্থানের ৮০ শতাংশ ভালো। তবে পায়ের ফোলাভাব পুরোপুরি কমেনি। ওষুধ দেওয়া হয়েছে। এরপর ২১ মে দুপুরে বন বিভাগের দল আবারও হাতিটির খোঁজ নেয়। তখন কলাগাছ, ধানসহ বিভিন্ন খাবার দেওয়া হয়। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত হাতিটির গতিবিধি নজরদারিতে রাখা হবে। প্রয়োজনে আবারও চিকিৎসা দেওয়া হবে।
হাতিটি বল্লমের আঘাতে আহত হয়েছিল জানিয়ে মধুটিলা ইকোপার্কের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. দেওয়ান আলী বলেন, ‘হাতিটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলত। চিকিৎসা দিতে পেরে ভালো লাগছে। এখনো নজরদারিতে রেখেছি। প্রয়োজনে আবারও চিকিৎসা দেওয়া হবে।’
শেরপুরের প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. শাহিন কবির বলেন, অসুস্থ হাতির খবর পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। এরপর সীমান্তবর্তী এলাকায় তাকে দুই দফায় চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বন্য হাতিকে বনে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার ঘটনা দেশে সম্ভবত এটাই প্রথম।
প্রতিবছরই ধান ও কাঁঠালের মৌসুমে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসে হাতি। এ সময় ফসল রক্ষায় মাঠে থাকা মানুষের সঙ্গে হাতিদের সংঘাত হয়। প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবে এবার ভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। অসুস্থ হাতির জন্য এগিয়ে এল বন বিভাগ। বনের প্রাণীকে চিকিৎসা দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে তারা।