নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
![]() |
আইডি কার্ড গলায় শ্রমিক মিনারা বেগম। হাসিমুখে ঘরে ফিরতে চান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
‘বৃষ্টিতে ভিজছি, রোদে শুকাইছি। এহন ভিজা কাপর শরীলে শুকাইতাছি। আমরা টাকার লাইগা আইছি, টাকা ছাড়া যমুনার সামনে থেকে যামু না। কেন আমরার লগে প্রতারণা করছে, উপদেষ্টাও আমরার লগে প্রতারণা করছে, সরকারে আমরারে লেখিত দিছে ৭ তারিখে আমরারে পাওনা-দেওনা বুঝাইয়া দিবে। কিন্তু তারার মিথ্যা কথায় আমরা আর এ রাস্তা ছাড়তাছি না।’ কথাগুলো বলছিলেন টিএনজেড গ্রুপের পোশাক কারখানায় চার বছর ধরে অপারেটর হিসেবে কাজ করে আসা শ্রমিক মিনারা বেগম।
শত শত শ্রমিক মিনারা বেগমের মতো বেতন–বোনাসের দাবিতে আজ মঙ্গলবার বেলা তিনটা থেকে রাজধানীর কাকরাইল মসজিদের সামনে সড়কের মোড়ে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে দুই দফায় দীর্ঘ সময় বৃষ্টিতে ভিজেছেন এসব শ্রমিক।
মিনারা বেগম যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন রাত ১০টা বাজে। দীর্ঘ সাত ঘণ্টা অবস্থান করলেও তাঁরা ঠিক জানেন না, কখন বাড়ি ফিরবেন। যে বেতনের আশায় আট দিন ধরে শ্রম ভবনের সামনে সড়কে অবস্থান করছেন, আজ যমুনার সামনে অবস্থান করছেন, সে আশা ঠিক পূরণ হবে কি না। তবে তাঁদের কথা হলো বেতন না নিয়ে বাসায় ফিরবেন না।
গেল ঈদে বাচ্চাদের কিছুই দিতে পারেননি। আরেক ঈদ আসছে। এবারও কি কিছু দিতে পারবেন না, সেই প্রশ্ন মিনারা বেগমের। তবে এবার বেতন নিয়েই ঘরে ফিরবেন বলে জোরের সঙ্গে বলেন এই নারী। তিনি বলেন, ‘কেন আমরার লগে প্রতারণা করছে। যমুনার সামনে থেকে বেতন নিয়া আমরা বাড়ি ফিরব। কালো মুখে আমরা যাইতে চাই না বাচ্চাদের সামনে। হাসিমুখে যাতে যাইতে পারি, এ অবস্থান কইরা এই জায়গা ত্যাগ করব।’
রাতভর এই সড়কে থাকবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মিনারা বেগম বলেন, আট দিন যখন শ্রম ভবনের সামনে গোসল ছাড়া, খাওয়া ছাড়া, ঘুম ছাড়া, মশার কামড় খেয়ে থাকতে পেরেছেন, তখন পুরো রাত কেন, দরকার হলে আরও ১০ দিন যমুনার সামনে থাকতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘তিন মাসের বকেয়া বেতন আছে, বোনাস আছে, আরও এমনি পাওনাদাওনা আছে। আমার চাকরিটা পয়সা দিয়ে ফ্যামিলি চলে।’
![]() |
কাকরাইল মসজিদের সামনে সড়কের মোড়ে রাতেও শত শত শ্রমিক অবস্থান নিয়ে আছেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
মিনারা বেগমের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের বিল কেরুয়া। স্বামী শহীদুল ইসলাম ও দুই মেয়েকে গাজীপুরে ভাড়া বাসায় থাকেন। পরিবার রেখে বেতনের জন্য দীর্ঘ ৯ দিন সড়কে অবস্থান করছেন তিনি।
টিএনজেড গ্রুপের পোশাক কারখানায় ৯ বছর ধরে কাজ করে আসছেন শ্রমিক শিখা রানী মজুমদার (৪৫)। তিনি বলেন, ‘আমরা বেতন না নিয়ে যামু না, এইডা হচ্ছে কথা। রাস্তায় লামছি যহন বেতন লইয়া দেশের বাড়ি চইলা যামু।’ তিনি বলেন, ৯ দিন ধরে বেতন–বোনাসের দাবিতে সড়কে অবস্থান করছেন। তাঁর আয় দিয়ে পরিবার চলত। স্বামী প্রেমানন্দ সরকার অসুস্থ হয়ে বাসায়। কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ চলে এ চাকরির টাকা দিয়ে।
গত ৮ এপ্রিল আরএমজিবিষয়ক ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (আরএমজি-টিসিসি) ২০তম সভায় টিএনজেড গ্রুপের চারটি কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়।
টিএনজেড গ্রুপের কাছে শ্রমিকদের পাওনা ৫৪ কোটি টাকা। গত ঈদুল ফিতরের আগে শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে ৩ কোটি টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়। প্রতিজন শ্রমিক ৯ হাজার ১০০ টাকা করে পান। বাকি বেতন, ঈদ বোনাস, নোটিশ পে, সার্ভিস বেনিফিটসহ যাবতীয় পাওনার দাবিতে ১১ মে থেকে টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীরা শ্রম ভবনের সামনে আন্দোলন করে আসছেন।
এদিকে আজ সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিক–কর্মচারীদের এ আন্দোলন নিয়ে সভা হয়। সভা শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, টিএনজেড লিমিটেড ও মাহমুদ গ্রুপের মালিকানাধীন জমি, বাড়ি, ফ্যাক্টরি ও স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা দ্রুত পরিশোধ করা হবে। একই সঙ্গে টিএনজেড লিমিটেড ও মাহমুদ গ্রুপের কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্য যেসব ফ্যাক্টরির মালিকের কাছে শ্রমিকদের বকেয়া রয়েছে তাঁদের তালিকা প্রস্তুত করে বকেয়া পরিশোধ করা হবে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা শ্রমিকেরা রাত ১০টার দিকে জানতে পারেন। এখন শ্রমিকেরা কী করবেন জানাতে চাইলে আন্দোলনের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।