![]() |
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) |
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আট মাসে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ জব্দ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাড়ি, ফ্ল্যাট, বাণিজ্যিক স্থাপনা ও জমি।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংস্থাটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ৭৪টি জব্দের আদেশ দিয়েছেন। এসব আদেশে প্রায় ১৯২ একর জমি, ২৮টি ভবন, ৩৮টি ফ্ল্যাট ও ১৫টি প্লট জব্দ করা হয়। জব্দের তালিকায় থাকা যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ২৩টি গাড়ি। তিনটি জাহাজও জব্দ করা হয়েছে।
দেশে ও বিদেশে থাকা জব্দের আদেশভুক্ত সম্পদের মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন দুদকের কর্মকর্তারা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুর্নীতি দমনে তৎপর হয় দুদক। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ আমলে সংস্থাটি তেমন কোনো তৎপরতা দেখায়নি। সরকার যার প্রতি নাখোশ অথবা গণমাধ্যমে যাঁর দুর্নীতি নিয়ে বেশি খবর প্রকাশিত হতো, তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানো হতো।
আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ এবং কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক ও কমিশনার (অনুসন্ধান) মোছা. আছিয়া খাতুন পদত্যাগ করেন গত ২৯ অক্টোবর। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাঁরা যত দিন দায়িত্বে ছিলেন, তত দিন কিছু তৎপরতা দেখিয়েছিলেন। দুদক কর্মকর্তাদের কারও কারও ভাষ্য, তাঁদের সেই তৎপরতা ছিল মূলত লোক দেখানো।
প্রায় ১৯২ একর জমি, ২৮টি ভবন, ৩৮টি ফ্ল্যাট ও ১৫টি প্লট জব্দ করা হয়। জব্দের তালিকায় থাকা যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ২৩টি গাড়ি। তিনটি জাহাজও জব্দ করা হয়েছে।
সরকার গত ১০ ডিসেম্বর দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকে নিয়োগ দেয়। কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয় মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাফিজ আহ্সান ফরিদকে। দুদক এখন নিয়মিত জব্দের আবেদন করছে। আদালতও আদেশ দিচ্ছেন।
সম্পদ জব্দ হওয়া ব্যক্তিদের সমন্বিত কোনো তালিকা দুদকের কাছে পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সময় আদালতের আদেশ সংবাদমাধ্যমে এসেছে। পাশাপাশি দুদক সূত্রেও বেশ কিছু নাম জানা গেছে।
শেখ পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন সম্পদ জব্দের তালিকায়। গত ৩০ এপ্রিল শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা ও তাঁর মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের জমি ও প্লট জব্দের আদেশ দেন আদালত। সম্পদ জব্দের আদেশ হওয়া সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন তাজুল ইসলাম, নসরুল হামিদ, এনামুর রহমান, জুনাইদ আহ্মেদ পলক, মির্জা আজম, জাকির হোসেন, জান্নাত আরা হেনরীসহ অনেকে। শেখ হাসিনার উপদেষ্টাদের মধ্যে সালমান এফ রহমানের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুর্নীতি দমনে তৎপর হয় দুদক। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ আমলে সংস্থাটি তেমন কোনো তৎপরতা দেখায়নি। সরকার যার প্রতি নাখোশ অথবা গণমাধ্যমে যাঁর দুর্নীতি নিয়ে বেশি খবর প্রকাশিত হতো, তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানো হতো।
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তসংস্থা টাস্কফোর্সের সভায় গত ১৬ এপ্রিল জানানো হয়, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার এবং ১০ শিল্পগোষ্ঠীর প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার শেয়ার জব্দ করেছেন আদালত। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা তাঁদের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে ও ৮৪ জনকে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
দুদকের দুজন মহাপরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কারও বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর পর সন্দেহজনক অবৈধ সম্পদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো জব্দ ও অবরুদ্ধের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়, যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তি এসব সম্পদ বিক্রি করে দিতে না পারেন। মামলার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তাঁরা আরও বলেন, বিচার শেষে দোষী সাব্যস্ত হলে এসব অবৈধ সম্পদ আদালতের নির্দেশে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ ও বাজেয়াপ্ত করতে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও দুদককে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানসরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁদের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে, তাঁদের একজন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক সহকারী পরিচালক মো. শামসুল আলম মিলকী। দুদক সূত্র বলছে, ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রাজধানীর উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে একটি আটতলা বাড়ি করেছেন তিনি।
গত রোববার সেখানে গিয়ে কথা হয় বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মো. সোহেল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাড়িতে ১০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাড়ির মালিক দ্বিতীয় তলায় থাকেন। এটা বাদ দিয়ে প্রতি মাসে আড়াই লাখ টাকা ভাড়া ওঠে। ভাড়া তোলা শেষে দুদকের কর্মকর্তাদের তিনি ফোন করেন। তাঁরা এসে টাকা নিয়ে যান।
দুদক এখন যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাঁরা বিগত সরকারে ছিলেন, অথবা সেই সরকারের সুবিধাভোগী। অতীতে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দুদকের তৎপরতা থাকে না বললেই চলে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও দুদককে ব্যবস্থা নিতে হবে। জব্দ করা সম্পদের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রক্রিয়া জটিল, তবে আদালতের রায় পেলে সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হয়। দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে জব্দ হওয়া সম্পদের ১০ শতাংশ সংস্থাটিকে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে সংস্থাটি উৎসাহিত হবে এবং তাদের একটি তহবিলও হবে।