প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জ

মা বেহুলা খাতুনের সঙ্গে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া দুই ভাই রিপন হোসেন (বাঁয়ে) ও ইমন হোসেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রিপন হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী মাঠে দিনমজুরের কাজ করেও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের (সম্মান) ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু অর্থের অভাবে আদৌ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাঁর। একই রকম দুশ্চিন্তা রিপনের বড় ভাই ইমন হোসেনেরও।

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ ইউনিটে (বিজ্ঞান বিভাগ) মেধাতালিকায় ৬০৩তম হয়েছেন রিপন। পাশাপাশি খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তাঁর বড় ভাই ইমন হোসেন এবার গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছেন।

রিপন হোসেন ওই উপজেলার কয়রা ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের মিন্নত আলীর ছেলে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে রিপন দ্বিতীয়। প্রায় পাঁচ বছর আগে তাঁর দিনমজুর বাবা মারা গেছেন। রিপন স্থানীয় দাদপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ এবং সরকারি আকবর আলী কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায়ও বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছেন।

নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভালো ফলাফল করে টাকার অভাবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে রিপনের। পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য স্বচ্ছল ব্যক্তিদের কাছে একটু সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, ‘অর্থের অভাবে কোচিং করতে পারি নাই। আমার এক বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে ভর্তির জন্য কোচিং করত। কোচিং শেষে আমি তার কাছ থেকে প্রতিদিনের সেই সব নোট ও বই ধার নিয়ে নিয়ে সেগুলো পড়তাম। বর্তমান অবস্থায় একটু সহযোগিতা পেলে আমি ভর্তি হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারতাম।’

দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় রিপনের বাবার মৃত্যু হয়। এর পর থেকে রিপন ও তাঁর বড় ভাই ইমন হোসেন লেখাপড়ার পাশাপাশি দিনমজুরের কাজ করে কোনোরকমে পরিবারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁরা ধান কাটা, রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজসহ দিনমজুরের কাজ করেন। ইমন গত বছর উল্লাপাড়া সরকারি আকবর আলী কলেজে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। এবার গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছেন। টাকার অভাবে তাঁর ভর্তিও অনিশ্চিত।

নিজেদের সংগ্রামের কথা তুলে ধরে রিপন হোসেন বলেন, ‘কোচিং বা প্রাইভেট পড়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমাদের ছিল না। একদিন কাজ না করলে সংসার চলে না। যে কারণে আমি যেদিন কলেজ করতাম, সেদিন আমার বড় ভাই কাজে যেত। বড় ভাই যেদিন কলেজে যেত, সেদিন আমি কাজ করতাম। এভাবে এত কষ্টের মধ্যে একসময় পড়ালেখা ছেড়ে পুরোপুরি দিনমজুরের কাজে যুক্ত হতে নিয়েছিলাম। কিন্তু পড়ালেখা কোনো অবস্থাতেই ছাড়তে পারিনি। এভাবেই কাজ করে আমার বড় ভাইয়ের গত বছর এইচএসসি পাসের পর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়নি। যে কারণে উল্লাপাড়া সরকারি আকবর আলী কলেজে ইসলামের ইতিহাসে ভর্তি হয়েছেন। তবে এবার গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় ৪ হাজার ৭০০তম হয়েছেন।’

রিপন–ইমনের বাকি ভাই–বোনেরাও পড়াশোনা করছে। বর্তমানে রিপনের ছোট তিন ভাই–বোনের মধ্যে লিখন হোসেন দশম শ্রেণিতে, মোহাম্মদ হোসেন প্রথম শ্রেণিতে ও বোন মার্জিয়া খাতুন শিশুশ্রেণিতে পড়ে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাঁদের মা বেহুলা খাতুন জানান, বাড়িতে তাঁর একটা টিনের ঘর ছাড়া আর কিছু নেই। স্বামী মারা যাওয়ার পর পড়াশোনার পাশাপাশি বড় দুই সন্তান রিপন ও ইমন কাজ করে সংসার চালান। দুই সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার জন্য বিত্তবানদের কাছে একটু সহযোগিতা কামনা করেছেন এই মা।

বেহুলা খাতুন বলেন , ‘আমার বড় দুই ব্যাটা ইমন হোসেন ও রিপন হোসেন সংসারের জন্যে মেলা কষ্ট করে। হেই বিয়ানা (ভোরে) গুম থাইক্যা উইট্যা কামে যায়। আবার রাইতে রাইতে মেলা কষ্ট কইরা নেহাপড়া (লেখাপড়া) কইরাই এপর্যন্ত আইছে। আমরা এক বেলা রাইন্দ্যা দুই বেলা খাই। অবাবের কারণে পোলাপাইনগোড়ে দুই বেলা গরম বাতই দিব্যার পারিন্যাই।’

ইমন হোসেন বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। যে কারণে অর্থ অভাবের মধ্যেই অনেক কষ্ট করেই গত বছর বিশ্ব বিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সুযোগ হয়নি। এবার পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে দরিদ্রতার কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াই এখন সম্ভব হচ্ছে না।’

ইমন ও রিপনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে সরকারি আকবর আলী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বুলবুল আহমেদ জানালেন বলেন, ওই দুই ভাই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী। অভাব তাঁদের পেছনের দিকে টেনে ধরলেও নেক কষ্ট, ত্যাগ ও সংগ্রাম করেই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু সহায়তা পেলে তাঁরা অনেক ভালো করবে।