প্রতিনিধি মৌলভীবাজার
![]() |
বেণীতে গাঁথা মালার মতো দুলছে হিজল ফুল। গত শুক্রবার মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরিতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
গ্রামটির এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ঘুমভাঙা শান্ত পরিবেশ। ‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে’—জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তির মতো ওখানে হয়তো পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকছে না, তবে থেমে থেমে দু-একটি ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে, ডাকছে আরও কিছু পাখি।
গ্রামটির পথের পাশে, খালের পাড়ে, বাড়ির সীমানায় ফুল-কুমারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিজলের একেকটি গাছ। খুব বেশি নয়, তারপরও এই গ্রীষ্মে নিজেদের আলাদা পরিচিতি নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে অন্য সব গাছের ভিড়ে মিলেমিশে আছে এই হিজলেরা। গাছে গাছে বেণিতে ঝোলানো মালার মতো দুলছে হিজল ফুলের ঝুমকা লতা। গাছ থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে এসব ফুল। গাছতলায় ঝরা ফুল লালচে, গোলাপি একপশলা চাদর হয়ে আছে। হাওয়ায় সেই ফুলের মৃদু ঘ্রাণ ভাসছে।
গত শুক্রবার এমন দৃশ্যের দেখা মিলল মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরি গ্রামে।
![]() |
হিজলের গাছ। গত শুক্রবার মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরি গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস সেই কবে গেয়েছিলেন, ‘হাওরের পানি নাইরে হেথায়, নাইরে তাজা মাছ/ বিলের বুকে ডানা মেলা, নাইরে হিজল গাছ।’ হাওরপারে আগের মতো হিজলগাছ আর নেই, এটা যেমন বাস্তবতা; তেমনি এখনো অনেক ঝড়ঝাপটা, কাটাকাটির ভেতরও জলাভূমির এই গাছ কিছু হলেও নিঃশব্দে বেঁচে আছে, টিকে আছে এই গ্রামে।
শুক্রবার সকাল, তখনো গ্রামের অনেক মানুষ জেগে ওঠেননি। বিচ্ছিন্নভাবে এক–দুজন করে জেগে উঠছেন, পথে বেরিয়ে আসছেন। অন্তেহরিতে তখন হাসতে হাসতে সূর্যের আলো আসছে। কাউয়াদীঘি হাওরপারের গ্রামটি একদম শান্ত, কোলাহলহীন। গ্রামের দক্ষিণ থেকে অন্তেহরি বাজার পেরিয়ে উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে সাত-আটটি হিজলগাছের সঙ্গে দেখা।
গ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে মাটির পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময় দূর থেকেই চোখে পড়ে একটি বাড়ির সীমানার কাছে একটি হিজলগাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। ঝুমকা লতার মতো অসংখ্য ফুলের লহরি ঝুলে আছে গাছের ডালে ডালে। গাছের কাছে যেতেই চোখে পড়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টুপ টুপ করে ফুল ঝরছে। ফুলের মধ্যে মৌমাছির আনাগোনা, এক ফুল থেকে আরেক ফুলে গিয়ে উড়ে বসছে মৌমাছি। গাছের নিচে অসংখ্য ফুল ঝরে আছে, যেন লাল-গোলাপি চাদর বিছিয়ে রেখেছে কেউ। মৃদু মিষ্টি গন্ধ বাতাসে লেগে আছে। পাশেই ঝোপের ভেতর বক ঘুমভাঙা স্বরে ডাকাডাকি করছে, ওড়াউড়ি করছে। বাড়ির আঙিনা, খালের পাড়ে, পথের পাশের প্রায় সব কটি হিজলগাছ থেকেই এ রকম ফুল ঝরে পড়ছে।
![]() |
ঝুলছে হিজল ফুল। এই ছবি মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরি গ্রামের | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, জলে প্রায় ডুবে থাকার জটিল পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত এ গাছ বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে জ্বালানি ও কাঠের অন্যতম প্রধান জোগানদার। হিজলের কাণ্ড নাতিদীর্ঘ, গাঁটযুক্ত, মাথা গোলাকৃতি, বাকল স্থূল, ঘন-বাদামি, রুক্ষ ও অমসৃণ। হিজলের পাতা একটু লম্বা ধরনের হলেও আকৃতি ডিমের মতো এবং শাখার শেষ প্রান্তে একান্তভাবে ঘনবিন্যস্ত। কচি অবস্থায় পাতা লালচে থাকে। পরে দ্রুত ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। বসন্ত হচ্ছে পত্রমোচনের কাল। কচি পাতার উজ্জ্বল সবুজে আচ্ছন্ন হিজল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বৈশিষ্ট্যেও হিজল একটি অনন্য ফুল। এমন বহুপৌষ্পিক দীর্ঘ, ঝুলন্ত মঞ্জরি অন্যত্র দুষ্প্রাপ্য। ছোট অথচ উজ্জ্বল ফুলের দীর্ঘ ঝুলন্ত মঞ্জরিতে হিজল অনেক রূপসী, চোখ কাড়ে। এ বৈশিষ্ট্যের জন্যই গ্রামবাংলার একান্ত আপন এই প্রিয় বৃক্ষটি কাব্যে, গল্পে এতটা সমাদৃত। হিজলের ফুল স্বল্পস্থায়ী এবং মৃদু সুগন্ধি। গ্রীষ্ম হচ্ছে ফুল ফোটার সময়। ফুল ঝরে গেলেই অজস্র ফলে শাখা নুয়ে আসে। কাঠ সাদা, নরম, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী। নৌকা, গরুর গাড়ি ও অন্যান্য সাধারণ কাজের উপযোগী। এ গাছের আদি আবাস অস্ট্রেলিয়া, মালয় ও বাংলা-ভারত। ছায়া ও ফুলের জন্য এটি তরুরাজ্যে একটি মর্যাদাবান এবং জলাভূমি অঞ্চলে রোপণের জন্য আদর্শ গাছ।
![]() |
মৌলভীবাজারের অন্তেহরি গ্রামে ঝরে পড়া হিজল ফুল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
স্থানীয় লোকজন জানালেন, কাউয়াদীঘি হাওরপারের বাড়িতে বাড়িতে, পথে পথে আগে অনেক হিজলের গাছ ছিল। কিন্তু এখন হিজলগাছ অনেক কমে গেছে। তারপরও এখনো বেশ কিছু হিজলের গাছ আছে অন্তেহরিতে। বিকেল থেকেই ফুল ফুটতে থাকে। রাতেও ফুল ফুটে। ফুল ফুটেই ঝরতে শুরু করে। সকালের আলো বাড়তে থাকলে একসময় গাছ ফুলশূন্য হয়ে যায়।
যেন হয়ে ওঠে জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তি—‘আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক পুকুরের জলে/ বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হল কবে/ কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল, আহা, চলে গেল কবে যে নীরবে...।’