প্রতিনিধি খুলনা
![]() |
কপোতাক্ষ নদে নৌকায় বসে রান্না করছেন এক জেলে, অন্য পাশে লম্বা দড়িতে কাঁকড়া শিকারের বড়শি বাঁধছিলেন আরেক জেলে। সোমবার | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ছোট্ট একটি ডিঙিনৌকায় গাদাগাদি করে সব জিনিসপত্র রাখা। নৌকার মাথায় টিনের চুলায় হাঁড়িতে ডাল-আলুর তরকারি রান্না করছেন ষাটোর্ধ্ব অহেদ আলী গাজী। কাঠের খুন্তি দিয়ে সামান্য তরকারি হাতে নিয়ে চেখে দেখলেন, লবণ ঠিকঠাক হয়েছে কি না।
নৌকার আরেক মাথায় বসে লম্বা দড়িতে কাঁকড়া শিকারের বড়শি বাঁধছিলেন জেলে রশিদ মোড়ল। তিনি বলেন, ‘এই নৌকাতেই আমাগের খাওয়াদাওয়া, ঘুম সবই চলে। আমরা দুজন প্রায় ১০ বছর একসঙ্গে জঙ্গলে যাই কাঁকড়া ধরতে। কিন্তু এইবার আর বনে না গিয়ে আইছি লোকালয়ের নদীতে। কারণ, সুন্দরবন এখন ডাকাইত ভরা। গত মাসে আমরা দুজন ডাকাইতের হাত থেকে কোনো রকমে বাঁইচে ফিরছি, সেই থেকে আর ভয়ে জঙ্গলে যাইনি।’
সোমবার বিকেলে খুলনার কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামসংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের তীরে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সুন্দরবনঘেঁষা নীলডুমুর গ্রামে।
আলাপচারিতায় বনজীবনের নানা গল্পের ফাঁকে অহেদ আলী বললেন, ‘সুন্দরবনের একেবারে পাশের এলাকার মানুষ আমরা। ছোটবেলা থেকেই জঙ্গলে যাই। বাঘ–কুমিররে কোনো দিন ভয় পাইনি। অথচ মানুষের ভয়ে আমাগের জঙ্গল ছাড়তি হলো। তিন দিন ধরে কপোতাক্ষ নদে দোন বড়শি (লম্বা শক্ত দড়ি) পাইতে কাঁকড়া শিকার করছি। এখানে বেশি কাঁকড়া পাইনি, তয় যা পাইছি, তাই নিয়ে আগামীকাল বাড়ি যাব।’
রশিদ মোড়ল নদীর পানিতে হাত ধুয়ে নৌকার পাটাতনে বসে বললেন, ‘গত মাসের শুরুর দিকে আমরা দুজন নৌকা নিয়া সুন্দরবনের বেশ গভীরে গিয়েছিলাম। পরদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ডাকাতদের সামনে পড়ি। ডাকাতরা আমাকে জিম্মি করে তাদের নৌকায় তুলে নেয়। অহেদ ভাই কোনোরকমে পালিয়ে বাড়ি চলে যান। আমি টানা চার দিন বন্দুকধারী দস্যুদের হাতে জিম্মি ছিলাম। পরে বাড়ির লোকজন বিকাশে ৩০ হাজার টাকা পাঠায়, তখন ছাড়ে। সেদিন মনে মনে কইছি, এইবার কোনোরকমে বাঁইচে আসতি পারলি, আর বনে যাইবি না।’
চুলা থেকে তরকারির হাঁড়ি নামিয়ে অহেদ আলী বলেন, ‘দোন বড়শি পেতে কাঁকড়া ধরতে ধরতে নীলডুমুর থেকে কয়রায় আইসে পড়ছি। নৌকা বেয়ে এই পর্যন্ত আসার মানে বোঝেন? পুরো দুই জোয়ার সময় লাগছে। এইখানে কাঁকড়াও বেশি পাইনি। তা–ও ডাকাত নেই, নিশ্চিতে আছি। সেদিন ডাকাতদের নিষ্ঠুর আচরণ দেখে মনে মনে বলেছিলাম, কোনোরকমে এইবার বাঁইচে আসতি পারলি আর সুন্দরবনে যাব না।’
![]() |
কপোতাক্ষ নদ থেকে মাছ ধরছে জেলেরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
মঙ্গলবার সকালে কথা হয় সুন্দরবন–সংলগ্ন কয়রার বনজীবী জেলে মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, বনদস্যুরা গত এক মাসে অন্তত অর্ধশতাধিক জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। এ জন্য এখন অনেকে বনে না গিয়ে ভ্যান চালিয়ে, কেউ দিনমজুরি করে আবার কেউবা লোকালয়ের নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরে সংসার চালাচ্ছেন।
আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবনের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে অভ্যস্ত এসব জেলের জীবন এখন অনিশ্চয়তায় ভরা। বনের ভয়াবহ বাঘ-কুমির নয়, ডাকাতদের ভয়েই তাঁরা আজ সুন্দরবন ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে হারিয়ে যাবে বনজীবী এই জনগোষ্ঠীর প্রাচীন পেশা ও জীবনধারা।
সম্প্রতি বনদস্যুদের মুক্তিপণ দিয়ে সুন্দরবন থেকে ফিরে আসা জেলেদের দেওয়া তথ্যমতে, এখন সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে করিম-শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, আনারুল বাহিনীসহ কয়েকটি দস্যু দল। তারা জেলেদের কাছে বিপুল অঙ্কের চাঁদা দাবি করছে, না দিলেই অপহরণের পর ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছে বনজীবীদের ওপর।
২৭ এপ্রিল সুন্দরবনে অস্ত্র, গোলাবারুদসহ বনদস্যু আনারুল বাহিনীর এক সদস্যকে আটক করে কোস্টগার্ড। এর আগে গত ১৮ এপ্রিল রাতে সুন্দরবনের আদাচাই এলাকা থেকে অস্ত্রসহ দস্যু শরীফ বাহিনীর দুই সহযোগীকে আটক করা হয়। এ ছাড়া গত ৯ এপ্রিল সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ডাকাত শরীফ বাহিনীর হাতে জিম্মি কয়রার ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।
কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট সিয়াম উল হক বলেন, দস্যুদের নির্মূলে অভিযান চলছে। গত বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৩৯০টি গুলি, ১০টির বেশি বোমা-ককটেলসহ ৮৫ জন দস্যুকে আটক করা হয়েছে।