প্রতিনিধি ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নে ছলিমের বাড়ি ও চান্দের বাড়ির গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দের জেরে ছলিমের বাড়ির পক্ষের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। গত শনিবার তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

রাস্তা-সংলগ্ন বাড়ি দুটির ফটকে তালা ঝুলছে। রাস্তা থেকে বসতঘরের খোলা জানালা দিয়ে আগুনে পোড়া আসবাবসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের ছলিমের বাড়ির মুজিবুর রহমানের ঘরের চিত্র এটি।

গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে মুজিবুরের ঘরসহ ছলিমের বাড়ির গোষ্ঠীর ৩০টি বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের পর আগুন দেওয়া হয়। ঘটনার পর ছলিমের বাড়ির লোকজন গ্রামছাড়া। অভিযোগ উঠেছে, প্রতিপক্ষ চান্দের বাড়ির লোকজন এই হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে।

১৪ মে পূর্ববিরোধ ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে মিয়াজুল হোসেন (৫০) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। তিনি নাটাই গ্রামের তোতা মিয়ার ছেলে এবং চান্দের বাড়ির গোষ্ঠীর লোক। তিনি সদর উপজেলা থেকে আশুগঞ্জের লালপুর পর্যন্ত সড়কে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, ঘটনার পর ১৫ ও ১৬ মে চান্দের বাড়ি গোষ্ঠীর লোকজন প্রতিপক্ষ ছলিমের বাড়ির গোষ্ঠীর বাড়িঘরে হামলা-লুটপাট চালায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদরের নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নের চান্দের বাড়ি ও ছলিমের বাড়ি গোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অনেক বছর ধরে বিরোধ চলে আসছে। চান্দের বাড়ি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আছেন সাবেক ইউপি সদস্য তকদির হোসেন ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোবারক হোসেন। ছলিম বাড়ির গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুল্লাহ বাহার, সাবেক ইউপি সদস্য গোলাম মিয়া, সাইদ মিয়া ও স্থানীয় বিএনপি নেতা কামাল হোসেন।

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, নাটাই মধ্যপাড়া, পশ্চিম পাড়া ও পূর্ব পাড়ায় ছলিমের বাড়ির লোকজনের অধিকাংশ বাড়িঘর ফাঁকা। নারী-পুরুষ কেউ নেই। বাড়িঘরে তালা ঝুলছে। বাইরে থেকে আগুনে পোড়া, লুটপাট ও ভাঙচুরের অবশিষ্ট অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। মধ্যপাড়ায় কয়েকজন বৃদ্ধ নারীকে দেখা যায়। তাঁদের একজন মুজিবুর রহমানের বাড়ির ফটকের তালা খুলে দিলে ভেতরে ঢুকে বসতঘরে আগুনে পোড়া আসবাব ও তোশক থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। কয়েকজন জানান, তাঁদের ৪২ ভরি স্বর্ণালংকার লুট হয়েছে। এ ছাড়া ৯ জনের ৩৭টি গরু নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।

নাটাই মধ্যপাড়ার জামাল মিয়ার স্ত্রী সুমি বেগম বলেন, গত বুধবার রাত নয়টার দিকে চান্দের বাড়ির লোকজন অতর্কিতে হামলা চালায়। কোলের তিন মাস বয়সী ছেলেকে টানাহেঁচড়া করেছে। বসতঘরের পাঁচটি কক্ষে তারা আগুন দিয়েছে। আগুনে সব পুড়ে গেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে হামলা–লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। গত শনিবার সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নাটাই বটতলী গ্রামের বাসিন্দা ফ্রান্সপ্রবাসী এস এম কাউসারের স্ত্রী রিয়া বেগম ও তাঁর ভাই এস এম কেয়ায়েতের স্ত্রী জান্নাত আক্তার বলেন, সন্তানদের নিয়ে, পরনের কাপড় নিয়ে কোনোমতে ঘর থেকে বের হয়ে প্রাণ রক্ষা করেছেন। না হলে তাঁদের পুড়িয়ে মারা হতো। পুরো বসতঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রিয়া তিন সন্তান নিয়ে এখন আখাউড়া উপজেলার দেবগ্রামে মায়ের বাড়িতে এবং জান্নাত তিন সন্তান নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বসবাস করছেন।

নাটাই বটতলীর আবদুর রহিম বলেন, ‘২৭ বছর সৌদি আরবে ছিলাম। দুই বছর আগে একেবারে দেশে চলে আসি। তিল তিল করে জমানো টাকা দিয়ে গড়া বসতঘরের সব লুট করে নিয়ে গেছে।’

ছলিমের বাড়ির আলী হোসেন ও সাবেক ইউপি সদস্য সামসু মিয়া বলেন, ‘আমাদের পক্ষের ৫০টি বসতঘরে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। অগ্নিসংযোগসহ লুটপাটে অনেক টাকার ক্ষতি হয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে চান্দের বাড়ি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে থাকা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।  

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোজাফফর হোসেন বলেন, মিয়াজুল হোসেন হত্যার ঘটনায় ১২৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে। ভাঙচুরের ঘটনায় ৩৮ জনকে আসামি করে অপর পক্ষ আরেকটি মামলা করেছে। হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৪৭ জনকে আসামি করে ছলিম বাড়ির লোকজন একটি এজাহার দিয়েছেন।