প্রতিনিধি সুনামগঞ্জ
![]() |
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট বাজার। বৃহস্পতিবার বিকেলে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় ইজারা না হওয়া চারটি বাজার ও নৌকাঘাটের খাস আদায়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌখিকভাবে দর নির্ধারণ করে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই এসব বাজার ও নৌকাঘাটের খাস আদায়ে কিছু লোককে দায়িত্ব দিয়েছেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ডাম্পের বাজার নৌকাঘাট, শ্রীপুর বাজার নৌকাঘাট, পাতারগাঁও বাজার নৌকাঘাট ও বাদাঘাট বাজার মামলা–সংক্রান্ত জটিলতায় এবার ইজারা হয়নি। চলতি বাংলা সন শুরুর পর এসব বাজার ও ঘাটে খাস আদায় করছিলেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। এ জন্য ইউএনও গত ১৪ এপ্রিল লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি এসব বাজার ও নৌকাঘাট থেকে খাস আদায়ের জন্য ইউএনও স্থানীয় লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি লিখিতভাবে এক ব্যক্তিকে, অন্য তিনটি মৌখিকভাবে তিনি অন্যদের অনুমতি দেন। এ জন্য ইউএনও মো. আবুল হাসেম কোনো রকম দরপত্র আহ্বান বা প্রকাশ্য উদ্যোগ নেননি। তিনি গোপনে এসব করছেন। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার বাজার ও নৌকাঘাটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় শ্রীপুর বাজার নৌকাঘাট থেকে। এটি ১১ মাসের জন্য উপজেলার ভাটি তাহিরপুর গ্রামের বাসিন্দা গোলাম মওলাসহ পাঁচ ব্যক্তিকে মৌখিকভাবে খাস আদায়ের অনুমতি দিয়েছেন ইউএনও। এবার বাংলা সন শুরু হওয়ার পর কিছুদিন এখানে উপজেলার ডিহিবাটি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা খাস আদায় করেন। এরপর হঠাৎ ওই ব্যক্তিরা গিয়ে জানান, ইউএনও তাঁদের খাস আদায়ের অনুমতি দিয়েছেন। এর পর থেকে তাঁরাই ঘাটের দখল নিয়ে অর্থ তুলছেন।
জানতে চাইলে গোলাম মওলা বলেন, ‘আমরা আলাদাভাবে নয়, তহশিলদারের সঙ্গে আছি। তাঁরাই টাকা তুলছেন। ইউএনও সাহেব বলেছেন সঙ্গে থাকার জন্য।’ কত টাকায় তাঁরা ঘাটে খাস আদায়ের অনুমতি পেয়েছেন জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
একইভাবে উপজেলার ডাম্পের বাজারে খাস আদায়ের জন্য কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দুটি বাজার ও ঘাট উপজেলার ডিহিবাটি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অধীন। ডিহিবাটি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী খাস আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কারা আদায় করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানে। আমি এর বেশি বলতে পারব না।’
উপজেলার তাহিরপুর–বাদাঘাট সড়কের পাতারগাঁও এলাকায় একটি নৌকাঘাট আছে। এটি উপজেলার কালীপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সামাদকে ১৪ মে লিখিতভাবে দিয়েছেন ইউএনও। এটি ছোট্ট একটি অস্থায়ী ঘাট বলে জানিয়েছেন ইউএনও আবুল হাসেম। আবদুস সামাদ বলেছেন, যত দিন নৌ চলাচল থাকবে, তত দিন তিনি টোল আদায় করবেন। তিনিও কত টাকায় ঘাটটি নিয়েছেন, সেটি জানাতে চাননি।
বাদাঘাট বাজার ও নৌকাঘাটে তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের খাস আদায়ের কথা থাকলেও আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এলাকার কিছু লোক খাস আদায় শুরু করেছেন। ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা প্রায় এক মাস ধরে বাজারে উপস্থিত হয়ে খাস আদায় করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাদাঘাট এলাকার পাঁচজন লোককে ইউএনও এই বাজার ও ঘাটে খাস আদায়ের জন্য গতকাল বুধবার রাতে মৌখিকভাবে অনুমতি দিয়েছেন। এই পাঁচজনের সঙ্গে আরও ২০ জন যুক্ত আছেন। বাজারটি সর্বশেষ ১৪২৯ বাংলা সনের জন্য ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা হয়েছিল।
আজ থেকে খাস আদায়ে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বাদাঘাট বাজার বণিক সমিতির সভাপতি নজরুল শিকদার ও সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ রয়েছেন। নজরুল শিকদারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। হারুন অর রশিদ বলেন, বাজারের নেতারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করেই খাস আদায়ে যুক্ত হয়েছেন। তবে তহশিলদারই সব দেখাশোনা করবেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইউএনওর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
বাদাঘাট বাজারের বিষয়ে ইউএনও আবুল হাসেম বলেন, গতকাল তাঁর কাছে বাজারের ৩০ থেকে ৩৫ ব্যবসায়ী এসেছিলেন। সবাই বাজারটি খাস আদায়ের জন্য নিতে চাইলে তিনি প্রতি মাসে চার লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার শর্তে তাঁদের অনুমতি দিয়েছেন। একইভাবে অন্য বাজার ও ঘাটগুলো দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
অইজারাকৃত বাজার ও নৌকাঘাট খাস আদায়ের নীতিমালার মধ্যে একটি হচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশাসনের কর্মকর্তা–কর্মচারী দিয়ে আদায় করবেন। অন্যটি হচ্ছে তিনি (ইউএনও) প্রকাশ্যে সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে সর্বোচ্চ দরদাতাকে খাস আদায়ের জন্য অনুমতি দেবেন।
তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা ও কনজ্যুমার রাইটস বাংলাদেশের উপজেলা শাখার সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, উপজেলায় খাস আদায়যোগ্য সব বাজার ও ঘাট নিয়েই একটা অস্বচ্ছতা দেখা যাচ্ছে। যাঁরা দেন ও যাঁরা নেন, দুই পক্ষের মধ্যে একটা রহস্য ও গোপনীয়তা দেখা যায়। সব হয় গোপনে। সরকার যে কী পায়, সেটি কেউ জানে না।
ইউএনও আবুল হাসেম বলেন, সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থেই এভাবে বাজার ও নৌকাঘাট তিনি খাস আদায়ের জন্য দিয়েছেন। তবে অন্য লোকজন আদায় করলেও এটি তদারকি করবেন তহশিলদাররা। কোনো বিজ্ঞপ্তি বা প্রকাশ্য উদ্যোগ ছাড়া তিনি একা এসব বাজার ও ঘাট খাস আদায়ের জন্য অন্যদের দিতে পারেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি শতভাগ সৎ। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থে কিছু লোক নিয়োগ করেছি। আমার তো এত লোকবল নেই।’