প্রতিনিধি বাগেরহাট
![]() |
আওয়ামী লীগের অফিস থাকা মাজার মোড়ের এই স্থাপনাটি এখন বিএনপির দখলে। বৃহস্পতিবার বিকেলে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বছর দুয়েক আগে হজরত খানজাহান (রহ.)–এর মাজার মোড়ে সড়কের জমি দখল করে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করে মহাধুমধামে উদ্বোধন করা হয়েছিল বাগেরহাট সদর উপজেলার আওয়ামী লীগের কার্যালয়। ৫ আগস্টের পর এই কার্যালয়টির সামনে এখন ‘আরাফাত রহমান কোকো ক্রীড়া সংসদ প্রধান কার্যালয়, বাগেরহাট জেলা’ লেখা ব্যানার।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানে ভবনটির আশপাশে থাকা কাঠ-বাঁশের অবৈধ স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভাঙা হয়নি ভবনটি।
বাগেরহাটে সড়কের জমি দখলমুক্ত করতে বুধবার ও বৃহস্পতিবার এই উচ্ছেদ অভিযান চালায় সওজ। দুই দিনে বাগেরহাটের টাউন নোয়াপাড়া থেকে বলেশ্বর সেতুর পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের দুই পাশে এই অভিযান চালানো হয়।
অভিযান মাজার মোড়ের এই স্থাপনাসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক কার্যালয় অক্ষত রয়ে গেছে। একসময় সেগুলো আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কার্যালয় ছিল। গত ৫ আগস্টের পর সেসব স্থাপনায় এখন ঝুলছে অন্য দল ও সংগঠনের ব্যানার।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, দরিদ্র চা-বিক্রেতা বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ছোট দোকানঘর ভাঙতে যে কঠোরতা ছিল, তা দেখা যায়নি প্রভাবশালীদের বেলায়। রাজনৈতিক দল, শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ব্যানারে থাকা অনেক কার্যালয়ই সড়কের জমি দখল করে আছে।
![]() |
আশপাশের সব স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও ভাঙা হয়নি বিএনপির কার্যালয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে সিঅ্যান্ডবি বাজার এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সড়ক বিভাগ বলছে, জমি পুনরুদ্ধার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ওই অভিযানে বাগেরহাট-পিরোজপুর মহাসড়কের দুই পাশে থাকা প্রায় ৫০০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। দুই দিনব্যাপী অভিযানে ৪০ কিলোমিটার এলাকার পুরোটাই দখলমুক্ত হয়েছে।
সওজের খুলনা জোনের এস্টেট ও আইন কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পীযূষ চন্দ্র দের নেতৃত্বে ওই অভিযান পরিচালিত হয়। সন্ধ্যায় এই অভিযান শেষ হয়।
সরেজমিনে বাগেরহাট শহরের দশানী থেকে সিঅ্যান্ডবি বাজার পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়কের পাশে অক্ষত অন্তত ১০টি কার্যালয় দেখা গেছে। আগে আওয়ামী লীগের কার্যালয় হলেও এগুলো এখন বিএনপি ও তাদের সমর্থিত বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রেস সোসাইটি ও মানবাধিকার সংস্থা, ব্লাড ব্যাংক, শ্রমিক ইউনিয়নের কিছু স্থাপনা অক্ষত দেখা গেছে।
![]() |
শ্রীঘাট মোড়ের আওয়ামী লীগ কার্যালয়টি রূপান্তরিত হয়ে এখন বিএনপির কার্যালয়। সেখানকার সব স্থাপনা ভাঙা হলেও এই কার্যালয়টি আছে আগের মতো | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
মহিদুল হক নামের এক ইজিবাইকচালক বলেন, ‘এগুলো ভাঙে না, খালি পারে গরিবের প্যাটে লাথি মারতি। সবগুলো আওয়ামী লীগের অফিস ছিল। এট্টাও ভাঙিনি।’
সদর উপজেলার শ্রীঘাট মোড় এলাকাতেও অক্ষত একটি মাত্র ঘর। আশপাশের সবগুলো দোকানঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অক্ষত ওই ঘরে বিএনপি, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল লেখা এবং দলীয় নেতাদের ছবি যুক্ত তিনটি ব্যানার। ছবি তোলার সময় ওই এলাকার ষাটোর্ধ্ব এক প্রবীণ এগিয়ে এসে বলেন, ‘ছবি তুলে কী হবে, আগে আওয়ামী লীগের অফিস ছিল, এহন বিএনপির। যহন যার ক্ষমতায়, বোঝো না! সাধারণ মানুষের তা সব ভাঙিছে ভালো মতো।’
শ্রীঘাটের মতো দশানী, মেঘনিতলা, মাজার, বারাকপুর, সিঅ্যান্ডবি বাজার মোড়ের চিত্রও একই। এসব স্থানে অস্থায়ী দোকান থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক হাটের জন্য বসানো চৌকি, খুঁটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বিভিন্ন নেতার ছবিযুক্ত দলীয় কার্যালয়গুলো ভাঙা হয়নি। দশানী মোড়ে এমন তিনটি স্থাপনা ভাঙা হয়নি। তবে এগুলোর কোনোটিতেই বাইরে থেকে কোনো দলীয় ব্যানার বা নেতাদের ছবি দেখা যায়নি।
স্থানীয় এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই তিনটি অফিসের একটিতে থাকা যুবদলের ব্যানার আগের দিন খুলে রাখা হয়েছে, তবে তা ভাঙেনি। ওই স্থানে ৫ আগস্টের আগে শ্রমিক লীগের অফিস ছিল। দশানী ব্লাড ব্যাংক লেখা আরেকটি অফিসও অভিযানে ভাঙা হয়নি। এটি ছিল আওয়ামী লীগের অফিস। ৫ আগস্ট বিকেলে পুড়িয়ে দেওয়ার পর সেখানে নতুন করে ঘর তুলে জামায়াত নেতাদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপর একটিতে ‘আন্তজেলা ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, মিনিট্রাক চালক শ্রমিক ইউনিয়ন’ লেখা ব্যানার আছে।
![]() |
বারাকপুর বাজারেও ভাঙা হয়নি দলীয় কার্যালয় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ছোট ছাপড়া দোকান করে সংসার চালানো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাঁদের সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেও অনেক স্থাপনা রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ অভিযোগ তুলছেন, অনেক পাকা স্থাপনা বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মাজার মোড়ের সবজি বিক্রেতা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘সপ্তাহে দুই দিন হাট। বিকেলে কয়ডা শাকপাতা নিয়ে আইসে বসি, বেচা হলি চলে যাই। আমরা তো কিছু দখল করিনি। চাইরখেন বাঁশ পোঁতা, তা–ও ভাইঙ্গে দিছে। বড়লোকগো কিছু ভাঙে না।’
কিছু স্থাপনা না ভাঙা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সওজের বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘এ রকম তো হওয়ার কথা না। এখানে কোনো পার্টি বা কিছু দেখা হয় নাই।’ পরে এলাকা ধরে অক্ষত স্থাপনাগুলোর কথা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় বিএনপির যে পার্টি অফিস, আমরা যখন ওখানে ভাঙতে গেছি, কনসার্ন যে ওয়ার্ড বা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁরা এসে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে খুলে নেওয়ার জন্য সময় নিয়েছেন। এ জন্য সরাসরি বুলডোজার লাগানো হয়নি। পার্টি অফিস, একটা পারপাসের পার্থক্য আছে।’ ‘কাউকে ফেভার করা হয়নি’ উল্লেখ করে নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, উচ্ছেদের বিষয়ে কোনো চাপ ছিল না। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।