আব্দুল কুদ্দুস ও গিয়াস উদ্দিন টেকনাফ সীমান্ত থেকে
কক্সবাজারের টেকনাফের নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী একদল রোহিঙ্গা। ২৮ এপ্রিল টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত, সহিংসতা ও খাদ্যসংকটের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের হিসাবে, গত এক বছরে ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন।
নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাড়ার পেছনে রাখাইনে আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মধ্যে সংঘর্ষকে বড় কারণ বলে জানিয়েছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা।তাঁরা বলছেন, গত কয়েক মাসে রাজ্যটিতে খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
আরআরআরসির অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গতকাল রোববার বলেন, ১ মে পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে রাখাইন রাজ্য থেকে নতুন করে পালিয়ে আসা ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। গত এক বছরের ব্যবধানে সীমান্ত অতিক্রম করে তাঁরা বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে এসেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন গত বছরের জুন-জুলাই মাসে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহায়তা দেওয়া হলেও তাঁদের জন্য ঘর বরাদ্দের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।
ওই দিন আরসা মংডুর প্যাথার গ্রামের কাছে পৌঁছে আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালায়। আরাকান আর্মিও পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলি ও সংঘর্ষের পর আরাকান আর্মি আরসাকে ঠেকাতে মাঠে নামে।
যে কারণে অনুপ্রবেশ
মিয়ানমারের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপ সম্পূর্ণরূপে দখল করলেও সেখানে আরসা সক্রিয় রয়েছে। তারা আরাকান আর্মির ওপর অতর্কিত আক্রমণ করছে এবং আরসার সঙ্গে বেসামরিক নাগরিকেরাও (রোহিঙ্গা) রয়েছেন। গত এপ্রিলে আরসার ৪০ জনের বেশি সদস্যকে অস্ত্রসহ আটক করে আরাকান আর্মি।
গত ২৮ এপ্রিল আরাকান আর্মি ও আরসার মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার খবর প্রকাশ করেছে রাখাইন রাজ্যের অনলাইন গণমাধ্যম ‘নিরানজারাত’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই দিন আরসা মংডুর প্যাথার গ্রামের কাছে পৌঁছে আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালায়। আরাকান আর্মিও পাল্টা গুলি চালায়। গোলাগুলি ও সংঘর্ষের পর আরাকান আর্মি আরসাকে ঠেকাতে মাঠে নামে। পরিস্থিতি খারাপ দেখিয়ে ওই দিন থেকে মংডু টাউনশিপে ঢোকার পথ ও শহরের দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় আরাকান আর্মি।
সম্প্রতি রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে টেকনাফের শালবন আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নেওয়া রোহিঙ্গা আবদুল গফুর বলেন, আরসাকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে আরাকান আর্মি তাঁদের (রোহিঙ্গা) ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। ঘরবাড়ি দখল করে রোহিঙ্গাদের গ্রামছাড়া করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ধান-চালও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা পুরুষদের ধরে নিয়ে ব্যারাক নির্মাণকাজে বাধ্য করা হচ্ছে। ঘরে ঘরে খাদ্যসংকট চলছে। আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় মাথাপিছু পাঁচ হাজার কিয়াত (মিয়ানমারের মুদ্রা, ১৮ কিয়াতে ১ টাকা) করে ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।
আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ দীর্ঘদিনের। রাখাইন রাজ্যে চরম খাদ্যসংকটের মধ্যেও আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের অত্যাচারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
— রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের ।
টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা আমির হামজা বলেন, তাঁর কিছু আত্মীয়স্বজন মংডুর সিকদারপাড়ায় বসবাস করেন। গতকাল যোগাযোগ করে তিনি জানতে পারেন, শুক্রবার সকালে আরাকান আর্মি সিকদারপাড়ায় ঢুকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। এরপর ঘরবাড়ি থেকে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের খোলা মাঠে জড়ো করে আরসাকে কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাঁদের নামধাম জানার চেষ্টা করেন। গত কয়েক দিনে রাখাইন রাজ্যের লডাইং, উচিংজং, নাকপুরা, কুলিপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকা থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
টেকনাফের হোয়াইক্যং থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত নাফ নদীর অন্তত ৪৫ কিলোমিটার সীমান্তে বিজিবিকে কঠোর অবস্থানে রাখা হয়েছে।
— টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান ।
রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ দীর্ঘদিনের। রাখাইন রাজ্যে চরম খাদ্যসংকটের মধ্যেও আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের অত্যাচারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতেও মাথাপিছু পাঁচ হাজার কিয়াত করে গুনতে হচ্ছে। আরাকান আর্মির আচরণের পরিবর্তন না ঘটলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জীবনেও সম্ভব হবে না। অনুপ্রবেশও ঠেকানো সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদী পার হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। কক্সবাজারের পালংখালী, ১ নভেম্বর , ২০১৭ | পুরনো ছবি |
রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের জানান, বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি (নতুন আসা ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা এই হিসাবের বাইরে)। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
তবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেশি হচ্ছে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের চারটি পয়েন্ট, উখিয়ার পালংখালীর পাঁচটি এবং টেকনাফের হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সাবরাং ইউনিয়নের ১৩টিসহ মোট ২২টি পয়েন্ট দিয়ে।
সীমান্তে ২২ পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ
গতকাল সকাল ৯টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত টেকনাফ-উখিয়ার নাফ নদীর অন্তত ৩৪ কিলোমিটার ঘুরে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। এ সময় নাফ নদীতে মাছ ধরার নৌকা চোখে পড়েনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জানান, রাত ১০টার পর নাফ নদীতে টহল সীমিত হয়ে পড়লে নৌকা নিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। ওই সময় চোরাকারবারিরাও সক্রিয় হয়।
তবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেশি হচ্ছে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের চারটি পয়েন্ট, উখিয়ার পালংখালীর পাঁচটি এবং টেকনাফের হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সাবরাং ইউনিয়নের ১৩টিসহ মোট ২২টি পয়েন্ট দিয়ে। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে অবস্থান নিলেও অনেকে বিভিন্ন গ্রামে লোকজনের বাসাবাড়িতে আত্মগোপন করেছেন। এমনকি ট্রলারে করে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী ও পতেঙ্গা এলাকায় পাড়ি জমাচ্ছেন অনেক রোহিঙ্গা। গত শনিবার পতেঙ্গা সৈকতের মুসলিমাবাদ বেড়িবাঁধ থেকে অনুপ্রবেশকারী ৩৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে র্যাব।
র্যাব-৭-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক এ আর এম মোজাফফর হোসেন বলেন, মিয়ানমার থেকে ট্রলারে করে রোহিঙ্গারা পতেঙ্গা ঘাটে নামেন। আটক রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী-শিশুও রয়েছে।
ট্রলারে করে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী ও পতেঙ্গা এলাকায় পাড়ি জমাচ্ছেন অনেক রোহিঙ্গা। গত শনিবার পতেঙ্গা সৈকতের মুসলিমাবাদ বেড়িবাঁধ থেকে অনুপ্রবেশকারী ৩৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে র্যাব।
টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, টেকনাফের হোয়াইক্যং থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত নাফ নদীর অন্তত ৪৫ কিলোমিটার সীমান্তে বিজিবিকে কঠোর অবস্থানে রাখা হয়েছে। গত চার মাসে এই সীমান্ত দিয়ে দৃশ্যমান রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির–সংলগ্ন কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করে আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
তবে রাতে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে বলে বিজিবির ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন। অনুপ্রবেশ ও মাদক চোরাচালান ঠেকাতে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।