প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জ
![]() |
এই বাড়িতে গুপ্তস্থানে আটকে রাখা হয়েছিল দুজনকে। শনিবার সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের সোনারাম গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জায়গাজমি নিয়ে বিরোধের জেরে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের সোনারাম পূর্ব পাড়ায় নির্মাণাধীন বাড়ির গুপ্তস্থানে দুজনকে আটকে রাখা হয়েছিল। শনিবার তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এ কথা জানিয়েছেন। এদিকে দুজনকে গুপ্তস্থানে আটকে রাখার ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ইউনিয়নের লক্ষ্মী বিষ্ণুপ্রসাদ গ্রামের মুনসুর আলীর স্ত্রী শিল্পী খাতুন (৪৮) ও পূর্ব পাইকড়া গ্রামের আবদুল জুব্বার (৭৫) ওই বাড়ি থেকে মুক্ত হন। তাঁরা চার-পাঁচ দিন কাঁচি দিয়ে মেঝে খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে গুপ্তস্থান থেকে বের হন। তাঁরা এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্থানীয় লোকজন জানান, বাড়িটির মালিক সুমন সেখ। তাঁর কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ভবনের নিচে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট কক্ষ করে গুপ্তস্থান বানিয়েছিলেন চান্দাইকোনা ইউনিয়নের পশ্চিম লক্ষ্মীকোলা গ্রামের মো. নাজমুল হোসেন তালুকদার (আরাফাত)।
![]() |
দুজনকে আটকে রাখার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তির পুড়িয়ে দেওয়া বাড়ি দেখতে মানুষের ভিড়। শনিবার সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের পশ্চিম লক্ষ্মীকোলা গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ভুক্তভোগী শিল্পী খাতুন এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। আজ সকালে তিনি বলেন, প্রায় পাঁচ মাস ধরে বন্দী ছিলেন তিনি। এক মাস অন্য জায়গায় রেখেছিলেন। তবে কোথায় রেখেছিলেন, তা তিনি জানেন না। মাঝেমধ্যে শরীরে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে রাখা হতো। তিনি বলেন, পল্লিচিকিৎসক নাজমুল হোসেন তালুকদার, শরীফ মেম্বার, কামরুল ইসলাম, হাফিজুল, পান্নাসহ কয়েকজন মুখোশ পরে ওই গুপ্তস্থানে যেতেন। একবেলা করে তাঁদের খাবার দেওয়া হতো।
শিল্পী খাতুনের স্বামী মুনসুর আলী জানান, গত ৩ ডিসেম্বর তাঁর স্ত্রী নিখোঁজ হয়। পরে তাঁরা জিডি করেছিলেন। এরপর ২৩ ডিসেম্বর র্যাব কার্যালয়ে ঘটনাটি জানান তাঁরা।
![]() |
আব্দুল জুব্বার ও শিল্পী বেগম | ছবি: সংগৃহীত |
শিল্পী খাতুনকে আটকে রাখার ঘটনায় তাঁর স্বামী মুনসুর আলী থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ১৩ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে পাঁচ–ছয়জনকে। এজাহারে বলা হয়, বিবাদীদের সঙ্গে জায়গাজমি নিয়ে বিরোধ ও মামলা–মোকদ্দমা চলে আসছে। এর জেরে তাঁর স্ত্রীকে ওই বাড়িতে নিয়ে আটকে রাখা হয়।
এদিকে গুপ্তস্থান থেকে উদ্ধার পাওয়া আবদুল জুব্বারকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাঁর ছেলে শফিকুল ইসলাম বলেন, তাঁর বাবা গত বছরের ৮ নভেম্বর বিকেলে নিখোঁজ হন। পরে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ১২ নভেম্বর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বলেন, জায়গাজমি লিখে নেওয়ার জন্য তাঁর বাবাকে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল।
রায়গঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আবদুল জুব্বারের ছেলে মো. শফিকুল ইসলাম ও শিল্পী খাতুনের স্বামী মুনসুর আলী থানায় পৃথক মামলা করেছেন।
বাড়ি দেখতে মানুষের ভিড়
‘গুপ্তস্থান’–কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে পশ্চিম লক্ষ্মীকোলা গ্রামের পল্লিচিকিৎসক মো. নাজমুল হোসেন তালুকদারের বিরুদ্ধে। তাঁর বাড়িতে গতকাল শুক্রবার আগুন ধরিয়ে দেন স্থানীয় বিক্ষুব্ধ লোকজন। আজ ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উৎসুক নারী-পুরুষের ভিড়। পোড়া বাড়িতে কেউ নেই। সদর দরজা বন্ধ। লোকজন বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন বলেন, আরাফাতের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে অনেকের মামলা ছিল। মামলার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে এসব বিষয় নিয়ে গ্রামে সালিসও হয়েছে। কিন্তু এ রকম ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত, তা ভাবতে পারছেন না।
গ্রামের সেলিম খান বলেন, আরাফাতের বাবা সাংবাদিক রেজাউল করিম তালুকদার মারা যাওয়ার পর তিনি কিছুটা অন্য রকম হয়ে যান। বিভিন্নজনের সঙ্গে মামলাসহ নানা রকম ঝামেলার কথা শুনেছেন। কিন্তু এ ঘটনার কথা শুনে সবাই অবাক।
ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালনরত রায়গঞ্জ থানার উপপরিদর্শক অনুপ কুমার সরকার বলেন, ‘আর যেন কোনো ঝামেলা না হয়, তাই আমরা এখানে আছি।’
এ গ্রাম থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের সোনারাম গ্রাম। এ গ্রামের নির্মাণাধীন বাড়িতে ছিল ওই গুপ্তস্থান। ওই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, অনেক নারী-পুরুষ সেখানে ভিড় জমিয়েছেন।
এই বাড়ির গুপ্তস্থানে মানুষকে আটকে চাঁদা আদায়, কিডনি বিক্রির হুমকি, জমি লিখে নেওয়াসহ নানা অপকর্ম পরিচালনা করা হতো বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ তুলেছেন।
এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যায় নাজমুল হোসেন তালুকদারকে রায়গঞ্জ প্রেসক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক আবুল কালাম বিশ্বাস।