প্রতিনিধি চট্টগ্রাম

শ্রমিক কবির হোসেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

২০০৭ সালের মে মাসে চাকরি হারান শ্রমিক কবির হোসেন। চাকরি ফিরে পেতে দ্বারস্থ হন আদালতের। এরপর ১৮ বছর হতে চলল। আইনি লড়াই এখনো শেষ হয়নি। মামলার খরচ জোগাড়ে হয়েছেন ঋণগ্রস্ত। ইতিমধ্যে মারা গেছেন মামলা পরিচালনাকারী দুই আইনজীবীও। ক্লান্ত কবির এখনো জানেন না কবে চাকরি ফিরে পাবেন।

চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকায় সিহান স্পেশালাইজড টেক্সটাইলে তাঁতি পদে কর্মরত ছিলেন কবির। বেতন ছিল ১ হাজার ২১৭ টাকা। কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁর করা মামলাটি বর্তমানে প্রথম শ্রম আদালত চট্টগ্রামে বিচারাধীন।

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকার একটি সরকারি বাড়িতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রম আদালতের কার্যক্রম চলে। দুটি শ্রম আদালতে এখন ১ হাজার ৯১৩টি মামলা বিচারাধীন। ১৫০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতের মামলা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি, সমন জারিতে দেরি, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়া, প্রতিনিধিদের মতামত প্রদানে দেরির কারণে শ্রম আদালতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মামলার বিচার ঝুলে আছে।

কবিরদের মতো শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে গড়ব এ দেশ নতুন করে’।

গত রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের শ্রম আদালত প্রাঙ্গণে কথা হয় কবির হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৮ বছর ধরে চালিয়ে নেওয়া এই লড়াইয়ের কথা।

আদালত সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের ৭ মার্চ চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকায় সিহান স্পেশালাইজড টেক্সটাইলে তাঁতি পদে যোগ দেন কবির হোসেন। অসৌজন্যমূলক আচরণ, এক সহকর্মীকে মারধরের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। তিনি এর উত্তর দিলেও তা সন্তোষজনক মনে না করে একই বছরের ২২ মে কবিরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

‘মিথ্যা অভিযোগে’ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে দাবি করে কবির ওই বছরের জুলাইয়ে প্রথম শ্রম আদালত চট্টগ্রামে মামলা করেন। এতে বিবাদী করা হয় কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইমরান আলী ভূঁইয়াসহ ১০ জনকে। মামলার পর বিবাদীরা কয়েকটি ধার্য দিনে হাজির হন। পরে আর হাজির হননি। একতরফা রায় দেন আদালত ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ। রায়ের আদেশে কবির হোসেনকে চাকরিতে পুনর্বহাল ও বকেয়া বেতন–ভাতা পরিশোধের নির্দেশ দেন আদালত।

কবির হোসেন বলেন, আদালত নির্দেশ দিলেও ফিরে পাননি চাকরি। শেষে ২০০৮ সালের ২২ মার্চ কারখানার এমডি ইমরান আলী ভূঁইয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশ অমান্য করায় ফৌজদারি মামলা করেন প্রথম শ্রম আদালত চট্টগ্রামে। এরপর কারখানা কর্তৃপক্ষ আদালতে হাজির হয়ে কবিরকে চাকরিতে পুনর্বহালের আদেশ দিয়ে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল (মিস মামলা) করে শ্রম আদালতে।

আবেদনে বলা হয়, একতরফা রায় হয়েছে। তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হোক। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কবির যে ফৌজদারি মামলা করেছেন সেটির কার্যক্রম যাতে স্থগিত রাখা হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট আদালত কারখানা কর্তৃপক্ষের করা মিস মামলার আবেদন মঞ্জুর এবং কবিরের করা ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, কার্যক্রম স্থগিত না রাখলে আইনগত জটিলতা দেখা দেবে।

আবার শুরু হয় কবিরের দৌড়ঝাঁপ, আদালতে দৌড়াদৌড়ি। রোদ–বৃষ্টি উপেক্ষা করে ধার্য দিনে হাজির হন আদালতে। এভাবে কেটে যায় ছয়টি বছর। এর মধ্যে ২০১১ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগে আক্রান্ত হন কবিরের বাবা আবদুল হালিম হাওলাদার। একদিকে মামলার খচর অন্যদিকে অসুস্থ বাবা।

কবির হোসেন বলেন, ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর প্রথম শ্রম আদালতে দুই তরফা শুনানি শেষে অর্থাৎ কবির ও তাঁর মালিকপক্ষের উপস্থিতিতে আদালত রায় দেন। সেই রায়ে তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহাল ও বকেয়া বেতন–ভাতা পরিশোধের নির্দেশ দেন আদালত। আগে দেওয়া রায় (২০০৮ সালের ২৫ মার্চ) বহাল রাখেন, মালিকপক্ষের করা মিস মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

আদালতের রায় নিয়ে কবির আবার হাসিমুখে ছুটে যান কারখানায়। কিন্তু এবারও তাঁকে নিরাশ হতে হয়। কবিরকে চাকরিতে পুনর্বহাল ও বকেয়া বেতন–ভাতা পরিশোধের চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করে কারখানা কর্তৃপক্ষ।

এবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় কবিরের। কেটে যায় সাড়ে চার বছর। এর মধ্যে ২০১৮ সালে আপিল খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। মালিকপক্ষ এটি পুনর্বিবেচনার আবেদন করে। আদালত তা মঞ্জুর করলে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ট্রাইব্যুনালে মালিকপক্ষের করা আপিল নামঞ্জুর করে শ্রম আদালতে দেওয়া রায় পুনর্বহাল রাখেন।

আপিল ট্রাইব্যুনালে রায় পেয়েও কবিরের ভাগ্যে জোটেনি চাকরি। আবার দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন আদালতপাড়া ও আইনজীবীর কাছে। ২০২০ সালের শুরুতে এক আইনজীবীর পরামর্শে আবার নতুন করে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেন। সাড়ে তিন বছর দৌড়ঝাঁপের পর বুঝতে পারেন তার আগের করা (২০০৮ সালের ২২ মার্চ) ফৌজদারি মামলা রয়েছে। সেটির স্থগিতাদেশ থাকবে না মালিকপক্ষের মিস মামলা ও আপিল নামঞ্জুর হওয়ায়।

গত বছরের ১৩ জুন মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আগের করা (২০০৮ সালের ২২ মার্চ) ফৌজদারি মামলা আবার চালুর জন্য প্রথম শ্রম আদালত চট্টগ্রামে আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করেন। কার্যক্রম শুরুর জন্য মালিকপক্ষের পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালত সমন জারি করেন। পরে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর ইপিজেড থানার এএসআই মাসুদ আলম আদালতকে লিখিতভাবে জানান, কারখানার ঠিকানায় গিয়ে ওই নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে বর্তমানে স্মার্ট জ্যাকেট (বিডি) নামে থাকা কারখানার উপমহাব্যবস্থাপক (এজিএম) ইউসুফ চৌধুরী জানিয়েছেন, আগের মালিকানা বিক্রি হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আদালত বাদী কবির হোসেনকে কারখানা কর্তৃপক্ষের ঠিকানা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। ১৩ মে পরবর্তী তারিখ রয়েছে।

কারখানার আগের এমডি ইমরান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী সুখময় চক্রবর্তী বলেন, অনেক বছর ধরে তাঁরা আর যোগাযোগ করেন না। এখন কোথায় আছেন জানেন না। বর্তমান কারখানার এজিএম ইউসুফ চৌধুরী জানান, শ্রমিক কবিরের যাবতীয় লেনদেন আগের মালিকের সঙ্গে।

বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় বাড়ি কবিরের। চাকরি হারোনোর পর সেখান থেকে চট্টগ্রামে এসে মামলার খোঁজ নেন। একবার আসা–যাওয়ায় তাঁর খরচ হয় তিন হাজার টাকা। বরিশালে বিভিন্ন কারখানায় দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে মামলার খরচ চালান। এ পর্যন্ত তাঁর সাত থেকে আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করেন।

শ্রমিকদের পাওনাসহ নানা দাবি সহজে আদায়ের জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে এগোনোর পরামর্শ দেন শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহীন চৌধুরী। তিনি বলেন, আইনের দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে শ্রম আইন বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কবিরের মামলা লড়ার জন্য মালিকপক্ষ যে টাকা খরচ করেছে তার অর্ধেক টাকা দিয়ে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিতে পারতেন। আপসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সচেতনতা বাড়াতে শ্রমিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত।

শ্রমিক কবির হোসেনের চাওয়া এখন আদালতের নির্দেশমতো চাকরিতে পুনর্বহাল হওয়া ও বকেয়া বেতন–ভাতা পাওয়া। তিনি বলেন, ‘অন্যায়ভাবে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ১৮ ধরে বছর ঘুরছি। আর কত দিন? বিচার কি পাব না?’