প্রতিনিধি পাবনা
বাগানে লিচুর ফলন কম হয়েছে। গাছে ধরা কয়েকটি লিচু দেখান এক নারী। সম্প্রতি পাকশী ইউনিয়নের রূপপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
পাবনার ঈশ্বরদীতে বাগানগুলোতে লিচুর ফলনে বিপর্যয় ঘটেছে। ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি লিচুর আকারও ছোট হয়েছে এবার। কৃষকেরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার ফলন ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কম হয়েছে।
এতে বাগানমালিক ও মৌসুমি লিচু ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন। মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টির দেখা না পাওয়ায় লিচুর ফলনে এ বিপর্যয় বলে মনে করছেন বাগানমালিকেরা। তবে হর্টিকালচার বিশেষজ্ঞদের দাবি, শুধু বিরূপ আবহাওয়ার কারণে নয়, নিয়মিত পরিচর্যা না হওয়ার কারণেও এমনটি ঘটছে।
উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে লিচুবাগান। সেসব বাগানে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে লিচু। কোথাও লিচুর রং সবুজ, কোথাও টুকটুকে লাল।
উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের তথ্য বলছে, এখানে তিন হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর বাণিজ্যিক বাগান রয়েছে। গাছের সংখ্যা তিন লাখের ওপর। এর মধ্যে দেড় লাখ গাছের বয়স ১৮-১৯ বছরের বেশি। এ ছাড়া সারা উপজেলাতেই বসতবাড়ির আশপাশেও রয়েছে প্রচুর লিচুগাছ।
উপজেলার সাহাপুর, সিলিমপুর, দাশুড়িয়া, মুলাডুলি, জয়নগর, মানিকনগর, আওতাপাড়া ও বাঁশেবাদাসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বাগানগুলোতে ফল খুব একটা নেই। ফলন বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃতির বিরূপতাকেই দায়ী করেছেন কৃষকেরা।
সিলিমপুর এলাকায় কৃষক রমজান আলী (৬৭) জানালেন, ‘সাধারণত প্রতিটি গাছে একবার একদিকের শাখায় বেশি ফলন হয়। অন্যদিকে বের হয় কচি পাতা। পরের বছর অপরদিকে বেশি ফলন হয়, এদিকে কচি পাতা। এবার তা হয়নি। প্রায় প্রতিটি বাগানের গাছে মুকুলের বদলে সারা গাছে এসেছে নতুন পাতা। তার ওপর যেসব গাছে মুকুল এসেছিল, প্রচণ্ড খরায় গুটি বের হওয়ার আগেই প্রচুর ঝরে গেছে। তাঁর কথায়, ‘মুকুল ঝাঁটা’ হয়ে গেছে। লিচুর আকারও বড় হয়নি। তাঁর নিজের বাগানে যেখানে প্রায় আট লাখ টাকার লিচু হয়ে থাকে, এবার সেখানে তিন লাখ টাকার লিচুও হয়নি।’
পাশে দাঁড়িয়ে কৃষক আনোয়ার হোসেন (৫৭) কথাগুলো শুনছিলেন। তিনি হঠাৎ কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘তাঁর তিনটি বাগান আছে। এবার বাগানে লিচুর মুকুল কম এসেছে। যেটুকু মুকুল ছিল, তার অনেকটাই ঝরে গেছে। পরে আবার টিকে থাকা গুটিও ঝরে গেছে। এবার লোকসানের হিসাব করে অনেক কৃষক বাগান পরিচর্যাও ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, ‘বাগানগুলো তিন বছরের জন্য ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলাম। গতবার তা শেষ হয়েছে। এবার নিজেই পরিচর্যা করেছি। কিন্তু আমার কপাল এমনই খারাপ যে বাগানে লিচুই ধরল না।’
প্রায় ১০ বছর ধরে ঈশ্বরদীতে আম-লিচুর বাগান কিনে ব্যবসা করছেন সিলেট উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের আজহারুল ইসলাম (৫৫)। তিনি বললেন, এর আগে লিচুর ফলন এত খারাপ হয়নি। এবার অনেক লোকসান হবে।
টেবুনিয়া হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক এ, এফ, এম গোলাম ফারুক হোসেন বলেন, ‘এটা একক কোনো কারণে ঘটেনি। এটা অনেকগুলো কারণের সমষ্টিগত ফলাফল। আমরা গাছ থেকে শুধু ফল নিয়েই যাব, তার যেটা প্রয়োজন তা দেব না, তাতো হয় না। এবার লিচুর ফলন কম হচ্ছে, আকারও ছোট। অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে এটা ঘটছে। গাছগুলো সুষম খাদ্য পাচ্ছে না।’
উপজেলায় প্রায় অনেক বাগানই চুক্তিতে বিক্রি হয়। যাঁরা বাগান নেন, লিচুর মুকুল আসার সময়টাতে তাঁরা পরিচর্যা করেন। আবার ফলন শেষে চলে যান। এর মধ্যে তেমন পরিচর্যা হয় না। পরিচর্যার অভাবে লিচু কমে যাচ্ছে। আর বাগানিরা মৌসুমের শুরুতে নানা ধরনের রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন, যার প্রভাব গাছের ওপর পড়ছে বলে মনে করেন এ, এফ, এম গোলাম ফারুক হোসেন ।
এ ছাড়া বিরূপ আবহাওয়াকে লিচুর ফলন কম হওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে টেবুনিয়া হর্টিকালচার সেন্টারের ওই কর্মকর্তা বলেন, লিচুর পুষ্পমঞ্জরির পরাগায়নের সময় তাপমাত্রা কম থাকা প্রয়োজন। কিন্তু শীত শেষে হঠাৎ গরম পড়ে গেছে। এর কিছুদিন পর হঠাৎ একটানা কয়েক দিন ভোরে কুয়াশা পড়েছে। এর ফলে পরাগায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে আবার খরা চলছে। বৃষ্টি কম হওয়ায় গুটিও ঝরে পড়েছে। এতে ফলের আকারও ছোট হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কোনো ফসলই এখন আর বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে করা যাবে না। আপনাকে অবশ্যই সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই ফসল আবাদ শুরু করতে হবে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, ‘এ বছর লিচুর ফলন কম হয়েছে। গাছের উৎপাদনক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। উৎপাদনক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে বাগানের নিয়মিত পরিচর্যা করতে কৃষকদের সচেতন করছেন বলে জানান তিনি।’