রাজধানীর বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় রোববার রাতে গুলি করে বিএনপি নেতা কামরুল আহসানকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা | ছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া

গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মার্কেটে দোকান বরাদ্দ, বাড্ডা এলাকায় কেব্‌ল টিভি–সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসা ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের জেরে বিএনপি নেতা কামরুল আহসানকে (সাধন) গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান বাড্ডার রবিন–ডালিম–মাহবুব গ্রুপের মাহবুবের মামা। তাঁকে গুলি করেছে বাড্ডার আরেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মেহেদী গ্রুপের অনুসারীরা। তাঁরা গত বৃহস্পতিবারও তাঁকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে।

রাজধানীর বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় গত রোববার রাতে গুলি করে হত্যা করা হয় কামরুল আহসানকে। এ ঘটনায় কামরুলের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। কামরুল আহসান হত্যার সঙ্গে জড়িত দুজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে দুই আসামিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীর গুলশানে পুলিশ প্লাজার সামনের সড়কে গত ২১ মার্চ সুমন মিয়া ওরফে টেলি সুমন (৩৩) নামের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। হত্যা মামলাটির ছায়া তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির একটি সূত্র বলছে, সুমন মিয়া ছিলেন মেহেদী গ্রুপের অনুসারী। তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছিল রবিন, ডালিম ও মাহবুব গ্রুপের লোকেরা। ব্যবসা, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এই হত্যার প্রতিশোধ নিতেও তাঁকে হত্যা করা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোক বলেন, পুলিশ প্লাজার সামনে গুলি করে একজন ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছিল। একইভাবে কামরুল আহসানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ওই হত্যার প্রতিশোধ নিতে গতকাল তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। তদন্ত শেষে হত্যার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, গত চার মাসে (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) শুধু রাজধানীতে ১৩৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ৩৮টি খুন হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে।

হত্যায় অংশ নেন চার যুবক

বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে রোববার রাত ১০টার দিকে গুলশান লেক পাড়ের পাশে গুদারাঘাট এলাকার একটি চায়ের দোকানের সামনে যান কামরুল আহসান। তিন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চেয়ারে বসে কথা বলছিলেন তিনি। গুলশান লেক পাড় থেকে হেঁটে রাত ঠিক ১০টা ৬ মিনিটে তাঁদের সামনে আসেন দুই যুবক। কোমর থেকে পিস্তল বের করে কামরুলের খুব কাছ থেকে গুলি করেন তাঁরা। পরে দৌড়ে একটি গলি দিয়ে লিংক রোডের দিকে চলে যান হামলাকারীরা। ঘটনাস্থল ও আশপাশের কয়েকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দুজন গুলি করলেও তাঁদের সঙ্গে আরও দুজনকে দেখা গেছে। ঘটনার কয়েক মিনিট আগে কামরুল আহসান যে দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন, সেটির পাশের একটি গলিতে ওই চার যুবককে একসঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। পরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যান তাঁরা।

ঘটনার সময় কামরুলের পাশে বসা ছিলেন জাকির হোসেন রূপক, আবুল হোসেন ও কামরুল ইসলাম বাবলু নামের তিন ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রায় প্রতিদিন ওই দোকানের সামনে বসে আড্ডায় দিই। গতকালও (রোববার রাত) আড্ডা দিতে বসেছিলাম। পেছন থেকে দুই যুবক এসে কামরুলকে গুলি করে।’

বিএনপির মিছিলের সামনে দলটির গুলশান থানা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান। গত রোববার রাতে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা | ছবি: সংগৃহীত

বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন বিএনপি নেতা কামরুল আহসান। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি ২০ বছর ধরে বাড্ডা এলাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসা করেন। সম্প্রতি কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি আবাসন নির্মাণের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলেন। কয়েক মাস আগে গুলশানে ডিএনসিসি মার্কেটে একটি দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন। কামরুল আহসানের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসা ও রাজনীতি নিয়ে কোনো বিরোধের কথা তাঁর স্বামী তাঁকে কখনো জানায়নি। রোববার সারা দিন তিনি গুলশানে ছিলেন। দুপুরে খাবার খেতে আসার কথা ছিল। ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেননি। পরে তাঁকে ফোন করে খেয়ে নিতে বলেন।

দিলরুবা আক্তার বলেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাসায় আসেন তাঁর স্বামী। তখন তিনি নামাজ পড়ছিলেন। বাসায় আসার পর তাঁর মুঠোফোনে একটা কল আসে। তিনি আবার বেরিয়ে যান। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই খবর পান, তাঁর স্বামীকে গুলি করা হয়েছে।

বিদেশ থেকে চাঁদাবাজির নেতৃত্ব

বাড্ডা এলাকা রাজধানীর একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। গুলশান-বারিধারা সংলগ্ন এই এলাকায় গড়ে উঠেছে আবাসন ব্যবসা, আসবাব ও পোশাক কারখানা, খাবারের দোকান, রিকশার গ্যারেজসহ নানা ধরনের ব্যবসা। এখানে রয়েছে ইন্টারনেট সেবাদাতা, কেব্‌ল টিভি সংযোগদাতা এবং এলপিজি গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও।

তবে এই ব্যবসাবান্ধব এলাকার আড়ালে সক্রিয় রয়েছে অন্তত তিনটি অপরাধী চক্র—জিসান গ্রুপ, মেহেদী গ্রুপ ও রবিন-ডালিম-মাহবুব গ্রুপ। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এদের সদস্য সংখ্যা অন্তত ৩৫, যাঁদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে। এঁদের মূল কাজ চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল। ভাড়ায় মানুষ খুন করে এসব চক্রের সদস্যরা। এঁদের মধ্যে জিসান দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একজন। তিনি দুবাই থেকে নিজের চক্র পরিচালনা করছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, মেহেদী গ্রুপের মেহেদী থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। আর রবিন-ডালিম-মাহবুব গ্রুপের রবিন, ডালিম ও মাহবুব থাকেন মালয়েশিয়ায়।

পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের সঙ্গে মিলেমিশে চাঁদাবাজি করেন এই চক্রগুলোর সদস্যরা। এসব অবৈধ টাকার ভাগ যায় রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে। তাই খুনের ঘটনা বন্ধ হয় না। আবার রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও প্রতিপক্ষের কাউকে হত্যা করতে এদের কাজে লাগিয়ে থাকেন।