প্রতিনিধি নওগাঁ
![]() |
আমের গুণগত মান ঠিক ও নিরাপদ রাখতে বিশেষ ধরনের কাগজের ব্যাগ দিয়ে আমকে আবৃত করা হচ্ছে। সম্প্রতি নওগাঁর পোরশা উপজেলার বন্ধুপাড়া এলাকার একটি আমবাগানে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নওগাঁর সাপাহার উপজেলার দোয়াশ গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা রায়হান আলম (৪৮) নিজ উপজেলার পাশাপাশি পত্নীতলা ও পোরশা উপজেলার ২০০ বিঘা জমিতে আমের চাষ করেছেন। বিদেশে রপ্তানির আশায় উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করে এ বছর তিনি বাগানের ৩ লাখ ২৫ হাজার আমে ফ্রুট ব্যাগিং করেছেন।
ফ্রুট ব্যাগিং হলো বিশেষ ধরনের কাগজের ব্যাগ দিয়ে ফলকে আবৃত করা। সবকিছু ঠিক থাকলে এই উদ্যোক্তার বাগানেই এবার ৯৭ টন নিরাপদ আম উৎপাদিত হবে।
শুধু রায়হান আলম নন, তাঁর মতো আরও অনেক চাষিই বিদেশে রপ্তানির আশায় উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করে নিরাপদ আম উৎপাদন করছেন। স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর নওগাঁয় ৫০ লাখ আম ফ্রুট ব্যাগিং করার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি আমের গড় ওজন ৩০০ গ্রাম করে ধরলে জেলায় এ বছর প্রায় দেড় হাজার টন নিরাপদ আম উৎপাদন হবে। বিদেশে রপ্তানির পাশাপাশি দেশের বাজারেও বিক্রি হবে এসব আম।
কৃষিবিদ, স্থানীয় আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সারা দেশের মধ্যে নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি রপ্তানিযোগ্য আম চাষ হয়ে থাকে। কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করে জেলার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাগানে আম চাষ হয় থাকে। এসব বাগানে আম পাড়ার অন্তত ৩০ থেকে ৪০ দিন আগে আমে ব্যাগিং করা হয়। এই সময়ে আমে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। এতে আমগুলো নিরাপদ হয়। তবে গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা বলছেন, নওগাঁয় যে পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য আম চাষ হয়, সে তুলনায় রপ্তানি হয় খুবই সামান্য। রপ্তানি না বাড়লে আমের কাঙ্ক্ষিত দাম পাবেন না চাষিরা। এ অবস্থায় নওগাঁর রপ্তানির বাধাগুলো দূর করার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে আধুনিক উদ্যোগের আশা করছেন চাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁয় এ বছর ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয়েছে পোরশা উপজেলায়, ১০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এরপরই বেশি আম চাষ হয়েছে সাপাহার উপজেলায়। সাপাহারে ৯ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। জেলায় এবার প্রতি হেক্টরে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৭৮ টন। এই হিসাবে ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২৩৪ টন। নওগাঁয় জুনের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত আমের ভরা মৌসুম। এখানে আম্রপালি, বারি আম-৪, গৌড়মতী, নাক ফজলি, ল্যাংড়া আম বেশি চাষ হয়ে থাকে। জেলায় যে পরিমাণ আম চাষ হয় তার ৬০ শতাংশই আম্রপালি। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে রপ্তানিতেও শীর্ষে সুমিষ্ট এই আম।
কৃষি কর্মকর্তা ও রপ্তানিযোগ্য আম চাষ করেছেন এমন ১০-১২ জন আমচাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর উড়োজাহাজের ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেশি হওয়ার কারণে ২০২৩ সালের তুলনায় অর্ধেকের কম আম রপ্তানি হয়েছিল। তবে এবার ভাড়া কমানোর কারণে রপ্তানি বাড়তে পারে বলে আশা করছেন চাষিরা।
সাপাহার উপজেলার আম ব্যবসায়ী মুন অ্যাগ্রো ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী রেদোয়ানুর রহমান, আমচাষি সাখাওয়াত হোসেন ও রায়হান আলম বলেন, উড়োজাহাজ ভাড়া বেশি হওয়া ছাড়াও বাংলাদেশে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে আরও কিছু বাধা আছে। এর মধ্যে বড় বাধা হচ্ছে, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের (চুক্তিতে চাষাবাদ) ভিত্তিতে আম চাষ না হওয়া। কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে রপ্তানিকারক ও আমাচাষি পর্যায়ে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ভিত্তিতে আম চাষের পরিসর বাড়াতে হবে। জেলায় গুটিকয় বড় আমচাষি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ভিত্তিতে আম চাষ করছেন। অন্যরা উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করে আম চাষ করেও রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছেন না। এ ছাড়া আম উৎপাদনকারী অঞ্চলে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট (ভিএইচটি) প্ল্যান্ট না থাকা আরেকটি বাধা। আমকে দূষণমুক্ত করতে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট করতে হয়। সরকারি পর্যায়ে ঢাকার শ্যামপুরে বাংলাদেশের একমাত্র এই প্ল্যান্ট আছে। সাপাহারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক আমচাষি ভিএইচটি প্ল্যান্ট স্থাপন করলেও সেটি খুব ছোট পরিসরে। সরকারি উদ্যোগে বড় পরিসরে নওগাঁয় একটি ভিএইচটি প্ল্যান্ট স্থাপন করা দরকার। আবার আম বাছাইয়ের জন্য প্যাকিং হাউস ও সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টিন) সনদ পেতে নওগাঁয় কৃষি বিভাগের সঙ্গনিরোধ শাখা স্থাপন করা দরকার।
পত্নীতলা উপজেলার আমচাষি সোহেল রানা অভিযোগ করেন, রপ্তানিকারকদের কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করে আম উৎপাদনে ঝোঁক নেই। তাঁরা বেশি লাভের আশায় বাজার থেকে নিম্নমানের আম কিনে বিদেশে রপ্তানি করে থাকেন। এতে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের আমের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। নিরাপদ আম উৎপাদন না করে নিম্নমানের আম রপ্তানির কারণে আম রপ্তানি বাড়ছে না।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে যাঁরা আম চাষ করছেন, তাঁদের সবাইকে নিরাপদ আম উৎপাদনে কৃষি বিভাগ পরামর্শ দিয়ে আসছে। শুধু বিদেশে নয়, দেশের ভোক্তাদেরও নিরাপদ আম সরবরাহ করা আমাদের লক্ষ্য। আমের গুণগত মান রক্ষা করতে ইতিমধ্যে নওগাঁর আমচাষিরা আমে ব্যাগিং করা শুরু করেছেন। এবার অন্তত ৫০ লাখ আমে ব্যাগিং করা হবে। জেলায় একটি ভিএইচটি প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য দুই-তিন বছর আগে প্রস্তাব কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। ওই প্রস্তাবেই প্যাকিং হাউস ও সঙ্গনিরোধ সনদ শাখারও চাহিদা পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেটির কোনো অগ্রগতি হয়নি।’