
সোহরাব হাসান
![]() |
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস | ছবি: সংগৃহীত |
গত বছর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়, তখন ঘূর্ণাক্ষরেও কেউ ভাবতে পারেননি, সাড়ে ৯ মাসের মাথায় তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব অনতিক্রম্য পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। এ সরকারের ভিত্তি ছিল সশস্ত্র বাহিনী, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলের সমর্থন। সমর্থন ছিল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের, যাঁরা কোনো পদ চাননি, চেয়েছেন দেশটি ভালোভাবে চলুক।
প্রথম কয়েক মাস রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের একটা সমঝোতামূলক সম্পর্ক ছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করতেন।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে দূরত্ব বাড়তে থাকে। গত বুধবার সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের বক্তব্যে বোঝা গেল, সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গেও অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব বেড়েছে। তিনি বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের ‘অন্ধকারে’ রেখে।
সব মিলিয়ে দেশে একধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা চলছে। কয়েকজন উপদেষ্টার ‘রাজনীতিবিরোধী’ অবস্থান এবং স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার কিছু বক্তব্য দীর্ঘ ১৫ বছরে নির্যাতন–নিপীড়নের শিকার হওয়া রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষুব্ধ করেছে।
মিয়ানমারে মানবিক বিপর্যয় রোধে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর জন্য মানবিক চ্যানেল তৈরি কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার বিষয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেনি। তদুপরি একজন ‘মুখপাত্রের’ বক্তব্য তাঁদের (রাজনীতিক) কাছে অপমানজনক মনে হয়েছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা জানান, ইশরাক হোসেনের ঘটনায় সরকারের অবস্থান ছিল পক্ষপাতমূলক। যেখানে নির্বাচন কমিশন তাঁকে মেয়র ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে, সেখানে রিটের অজুহাতে তাঁর শপথ আটকে দেওয়া দুরভিসন্ধি বলে মনে করেন তাঁরা।
প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, আলোচনার মাধ্যমে সেটা দূর করে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করাটাই এখন সরকারের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। এখানে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা বিকল্প চিন্তার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।
তাঁরা আরও জানান, প্রায় সপ্তাহব্যাপী নগর ভবন ও রাজপথের আন্দোলনের কারণে যে নগরবাসী অবর্ণনীয় ভোগান্তির মধ্য পড়েছেন, সে ব্যাপারে তারা অবগত। বিএনপিও এটা করতে চায়নি। কিন্তু চার দিন ধরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেও যখন নেতারা ব্যর্থ হলেন তখনই সংবাদ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেন। বিএনপির অভিযোগ, এই জনদুর্ভোগের দায়ও সরকারের। এনসিপি নেতার এক ঘণ্টার আলটিমেটামের মুখে উপদেষ্টা পরিষদ জরুরি বৈঠক ডেকে তাদের দাবি মেনে নিলেও ইশরাকের বিষয়টি ছয়দিন ঝুলিয়ে রাখা অপমানজনক।
বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন ও সরকারের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার অব্যাহতি দাবি করেছেন। তাঁদের ভাষ্য হলো, ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখা কঠিন হবে।
বুধবার ইশরাক ইস্যুতে যখন বিএনপির নেতা–কর্মীরা কাকরাইল মোড়ে আন্দোলন করছিলেন, তখন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও সবার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। তারা নির্বাচন কমিশনকে বিএনপির আজ্ঞাবহ হিসেবেও অভিহিত করে। এই কমিশন এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচন করেনি, এমনকি সীমানা নির্ধারণের কাজও শেষ হয়নি। তার আগেই কাউকে আজ্ঞাবহ বলা কতটা সমীচীন সেই প্রশ্নও আছে। আর কোন নির্বাচন আগে হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক সরকার, নির্বাচন কমিশন নয়। এনসিপি নেতারা সরকারের তিন উপদেষ্টাকে বিএনপির সমর্থক বলে তাঁদের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
ইশরাকের পক্ষে আদালতের রায় পাওয়ার পরও ৪৮ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দলটি একই সঙ্গে সরকার ও এনসিপির সঙ্গে সমুখ সমরে অবর্তীণ হলো। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম যমুনায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
রাতে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারবেন না, এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি যদি কাজ করতে না পারি...যে জায়গা থেকে তোমরা আমাকে আনছিলে একটা গণ–অভ্যুত্থানের পর। দেশের পরিবর্তন, সংস্কার । কিন্তু যেই পরিস্থিতি যেভাবে আন্দোলন বা যেভাবে আমাকে জিম্মি করা হচ্ছে। আমি তো এভাবে কাজ করতে পারব না।’
সেই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগের মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার অনুরোধ করেছেন এনসিপি নেতা। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবও ব্যক্তিগত ফেসবুক বার্তায় একই অনুরোধ জানিয়েছেন।
আমরাও মনে করি, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, আলোচনার মাধ্যমে সেটা দূর করে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করাটাই এখন সরকারের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। এখানে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা বিকল্প চিন্তার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।
অন্তর্বর্তী সরকারকে সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ থাকতে হবে। এখানে কাউকে কোনো দলের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা যেমন অন্যায়, তেমনি কারও যদি দলীয় রাজনীতির অভিলাষ থেকে থাকে, তারও উচিত হবে পদত্যাগ করে সরকারকে বিতর্কমুক্ত রাখা।
নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করেই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন ও দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এখানে সরকারে থেকে কেউ দলীয় রাজনীতি করতে চাইলে সমস্যা আরও বাড়বে। কোনো উপদেষ্টা এক দলকে সমর্থন করলেও অন্য উপদেষ্টারা অন্য দলের প্রতি ঝুঁকবেন। এটা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হবে।
গণ–অভ্যুত্থানে সক্রিয় রাজননৈতিক দলগুলো ও ছাত্রনেতৃত্ব একে অপরের বিরুদ্ধে যে ভাষায় কথা বলছেন, বিষোদ্গার করছেন, তা খুবই হতাশাজনক। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের প্রতি উচ্চারণ–অযোগ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন ক্ষমতাসীনেরা। কিন্তু রাজনীতিতে ‘ডাস্টবিন’ সংস্কৃতি, ‘সান্ডা ও বোতল’ সংস্কৃতি তখনো ছিল না। আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানকে নগ্নভাবে ব্যবহার করা হতো। এখন ব্যবহার করা হচ্ছে মবতন্ত্র।
আমরা যদি দেশে ন্যূনতম গণতন্ত্র চাই, তাহলে এই মবতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানকে দলীয় কাজে ব্যবহারের অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে অবিলম্বে সুস্পষ্ট রূপরেখা দিতে হবে, এখানে ডিসেম্বর না জুন—এই বিতর্কের সুযোগ নেই। অবিলম্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সরকার নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই এই অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা অনেকটা কেটে যাবে আশা করি।
● সাংবাদিক ও কবি
[মতামত লেখকের নিজস্ব]