নিজস্ব প্রতিবেদক

পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫–এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা। মঙ্গলবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনকে জাতীয় নির্বাচনের সময় ধরে সারা দেশে পুলিশকে এখন থেকে প্রস্তুতির তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে এমন তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ থাকার প্রতিও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

পুলিশ সপ্তাহের তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের প্রথম দিন মঙ্গলবার বিভিন্ন ধাপের আলোচনায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসেছে।

এদিন সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫–এর উদ্বোধনকালে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতির ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে পুলিশ সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে রাখবেন, কোনো ব্যক্তি যদি অন্যায় বা অনিয়মের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়, সেই ব্যক্তির দ্বারা ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুতরাং কারও দ্বারা ব্যবহৃত হবেন না।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) দিয়ে কাজ করাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলেও উল্লেখ করেন এসপিদের কেউ কেউ। পছন্দের ব্যক্তিকে থানার ওসি করার জন্য রাজনৈতিক চাপের কথাও বলেছেন একাধিক কর্মকর্তা।

পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫–এর উদ্বোধন ও পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

উদ্বোধনসহ দিনের প্রথমার্ধের অনুষ্ঠান শেষে বেলা আড়াইটায় পুলিশ সুপার (এসপি) থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কর্মশালা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কর্মশালায় বিভিন্ন জেলার এসপিরা কাজের অভিজ্ঞতা ও নানা চ্যালেঞ্জের কথা বলেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) দিয়ে কাজ করাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলেও উল্লেখ করেন এসপিদের কেউ কেউ। পছন্দের ব্যক্তিকে থানার ওসি করার জন্য রাজনৈতিক চাপের কথাও বলেছেন একাধিক কর্মকর্তা।

চাপমুক্ত হয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অন্তরায়ের কথা বলতে গিয়ে একাধিক কর্মকর্তা জানান, পেশাদারত্বের বাইরে গিয়ে মাঠপর্যায়ের পুলিশের অনেকের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বাড়তি সখ্য তৈরির প্রবণতা রয়েছে। এতে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

পুলিশের বিভাগীয় হাসপাতালে জনবল বৃদ্ধি ও আধুনিক চিকিৎসাসরঞ্জাম সরবরাহ ও রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে মেডিকেল কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানাবে পুলিশ।

মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা রাজনৈতিক দলমুখী না হয়ে যেন পেশামুখী হন, সে জন্য করণীয় নিয়েও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এ জন্য পুলিশ সপ্তাহের শেষ দিনের অনুষ্ঠানের কোনো এক পর্যায়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে কীভাবে যুক্ত করা যায়, তা নিয়েও ভাবছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম তাঁর বক্তব্যে ও নির্দেশনায় সব স্তরের পুলিশ সদস্যদের পেশাদারত্ব ও সততার সঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশ যাতে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে, সে জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে বলেছেন তিনি।

মানুষ আর দলীয় পুলিশ চায় না

পুলিশ সপ্তাহের প্রথম দিনের আলোচনায় স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠনের দাবি উঠে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে। এদিন সকালে প্রধান উপদেষ্টার সামনে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে দুজন কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। এঁদের একজন পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আল আসাদ। আরেকজন ঢাকা জেলা পুলিশের কনস্টেবল সামিয়া ইসলাম স্বর্ণা।

অনুষ্ঠানে এএসপি মো. আল আসাদ বলেন, সাবেক স্বৈরাচারী সরকার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে। যার ফলে জনগণের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। পুলিশ বাহিনীকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করার সময় এখনই। জুলাই বিপ্লবের অংশীদারদের কেউই, এমনকি সাধারণ জনগণও আর দলীয় পুলিশ চান না, তারা নিরপেক্ষ ও নতুন বাংলাদেশের পুলিশ চান।

মো. আল আসাদ বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে একটি নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করলেও আরও পর্যালোচনা প্রয়োজন বলে বিষয়টি উপেক্ষা করেছে। এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেও পুলিশ–সংক্রান্ত কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পুলিশকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান এই কর্মকর্তা।

‘পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পুলিশ সদস্যদের পদক প্রদান করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সরকারি ছুটির বিপরীতে ভাতা দাবি

মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের পক্ষ থেকে কনস্টেবল সামিয়া ইসলাম তাঁদের সমস্যা ও কিছু হতাশার কথাও তুলে ধরেন। এ সময় আলোচনায় উঠে আসে, সাধারণ সরকারি কর্মচারীরা বছরে প্রায় ১২৯ দিন ছুটি ভোগ করেন। সেখানে পুলিশ সদস্যদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিনেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। দৈনিক ৮ কর্মঘণ্টার জায়গায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা।

এই পুলিশ সদস্য আরও বলেন, বিরামহীন এ দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ সদস্যরা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও পারিবারিক চাপের সম্মুখীন হন। তিনি পুলিশ সদস্যদের বছরে নির্ধারিত ১২৯ দিনের সরকারি ছুটির বিপরীতে কমপক্ষে এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ ভাতা দেওয়ার দাবি জানান।

আরও যেসব দাবি জানাবে পুলিশ

প্রধান উপদেষ্টার সামনে বিভিন্ন পর্যায়ের সাতজন পুলিশ সদস্যের আলোচনায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। সময় স্বল্পতার কারণে দুজন সদস্য প্রধান উপদেষ্টার সামনে কথা বলতে পেরেছেন। বাকিদের বক্তব্যে যেসব বিষয় উঠে আসার কথা ছিল, সেগুলো বুধবার সন্ধ্যা সাতটায় উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনায় তুলে ধরার কথা রয়েছে। এই অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টার থাকার কথা রয়েছে।

পুলিশ সপ্তাহের বুধবার ও বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে সাইবার সুরক্ষা ও সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশের স্বতন্ত্র সাইবার ইউনিট প্রতিষ্ঠার দাবির কথা আসতে পারে। পাশাপাশি খুন, সড়ক দুর্ঘটনা, অপমৃত্যু ও অজ্ঞাত লাশ হিসেবে প্রতিবছর দেশে গড়ে ৩০ হাজার মৃতদেহের ব্যবস্থাপনা, পরিবহন, সুরতহাল, ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো এবং ডোমের খরচের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়ার দাবিও জানানো হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর মানব পাচারের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত লিবিয়ায় নানাবিধ নির্যাতন ও অপরাধ প্রতিরোধের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাংলাদেশ দূতাবাসে পুলিশ লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগের দাবি জানাতে পারে পুলিশ। পুলিশের বিভাগীয় হাসপাতালে জনবল বৃদ্ধি ও আধুনিক চিকিৎসাসরঞ্জাম সরবরাহ ও রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে মেডিকেল কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানাবে পুলিশ। তা ছাড়া কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত একই পদে দীর্ঘদিন চাকরি করার পর অবসরকালে উচ্চতর ধাপে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি দেওয়ার দাবিও উঠতে পারে বলে জানা গেছে।