প্রতিনিধি পাবনা
![]() |
পাকশীর পদ্মা তীরে বটগাছের ছায়ায় দুজন ব্যক্তি মোবাইলে গেম খেলছেন, পাশে বিশ্রামে এক ক্লান্ত বৃদ্ধ। সোমবার দুপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আজ সোমবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, পাকশী ইউনিয়নের পদ্মা নদীর তীরে হঠাৎপাড়া এলাকার পল্টন ঘাটে বিশাল বটগাছের ছায়ায় প্রতিদিন জমে ওঠে জীবনের নানা দৃশ্য। দুপুরের তপ্ত রোদ আর পদ্মার মৃদু বাতাসে এখানে জড়ো হন ক্লান্ত পথচারীরা—কেউ বিশ্রামের আশায়, কেউবা একটু প্রশান্তি খুঁজে।
গাছের নিচে বসে থাকা আলম মৃধা (৫৩) বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই দেখি এই বটগাছ। তখন নদী ছিল আরও উজান, মাছও বেশি ছিল। এখন জীবন বদলে গেছে। রোজগারের জন্য রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে কাজ করি। তবু পদ্মার হাওয়ায় বসলে মনটা হালকা লাগে।'
![]() |
পাকশী ইউনিয়নের হঠাৎপাড়া গ্রামের বটগাছ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
এক কোণে বসে মাটি দিয়ে চুলা বানাচ্ছিলেন রওশন আরা (৪৮)। হাতের কাজ থামিয়ে তিনি বলেন, 'নিজের হাতে বানানো চুলায় রান্না করতে সুবিধা হয়। কাঠ-লাকড়ি জ্বালিয়ে সহজে রান্না করা যায়, খরচও কমে।'
পদ্মার পানিতে ছুটোছুটি করছে পাঁচ-ছয়জন শিশু। তাদের হাসির শব্দে নদীতীর মুখর। একটু দূরে বড়শি নিয়ে বসে ছিলেন ৬৫ বছরের মজিবর রহমান। বড়শিতে টান দিতেই তিনি বলেন, 'আগে পদ্মায় দাঁড়ালেই মাছ উঠত। এখন দিন শেষ হয়, তবু একটা মাছও ধরা পড়ে না। তবু চেষ্টা করি। নদীও জীবনের মতো—কখনও দেয়, কখনও কেড়ে নেয়।'
পদ্মার পাড়ে সবুজ ঘাসে ছেড়ে দিলে দিনভর ঘাস খেয়ে খামারে ফেরে ভেড়া | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নদীর পাড়ে ভেড়ার পাল নিয়ে এসেছেন রাখাল যুবক রফিক। ভেড়াগুলো নরম ঘাসের গন্ধে ছুটে বেড়াচ্ছে। রফিক বললেন, 'গ্রাম বদলাচ্ছে, মানুষ শহরে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এখনো মাটির সঙ্গেই আছি। এই ভেড়াগুলোই আমাদের জীবন।'
একদিকে হুড়মুড় করে ছুটে চলা মহিষের পেছনে দৌড়াচ্ছিলেন কবীর গাজী। হাপাতে হাপাতে বললেন, 'মহিষ হারালে বড় ক্ষতি। বিক্রি করে ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাই। এই মহিষ আমার পরিবারের মতো।'
বটগাছের ছায়ায় বসে ৫৯ বছরের আব্দুল গফুর মিয়া স্মৃতির পাতায় হারিয়ে গেলেন। বললেন, 'শৈশবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে এই পল্টন ঘাট ছিল আমাদের খেলার মাঠ। এখন চারপাশে কারখানা, ইঞ্জিনের শব্দ। তবু এই বটগাছ আর পদ্মার বাতাস বুক ভরে নিশ্বাস নিতে দেয়।'
একপাশে মোবাইল ফোনে লুডু খেলায় ব্যস্ত কয়েকজন ব্যক্তি। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও ছায়াঘেরা গাছ, নদী আর মানুষের প্রাণচাঞ্চল্যে এখনো গড়ে উঠেছে একখণ্ড প্রাণের গ্রাম।
শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে একটু মুক্তি পেতে পাকশীর পদ্মা নদীর কূলঘেঁষা পুরনো বটগাছের ছায়ায় বসেছেন তরুণ নীরব হাসান। নদীর ধারে বসে চোখ মুঠো করে শান্তি খুঁজে ফিরছেন তিনি। নীরব বলেন, ‘শহরে দিনগুলো কাটে দৌড়ঝাঁপে। ভোর থেকে রাত, শুধু কাজ আর চাপ। এখানে এসে মনে হচ্ছে, সময় যেন থমকে গেছে। নদীর ঢেউ আর বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে মনটা হালকা হয়ে যায়।’
![]() |
মহিষ চরিয়ে বাড়িতে ফিরছেন কবীর গাজী | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
তিনি আরও বলেন, ‘এই বটগাছটা ঠিক যেন ছায়াদানকারী বন্ধু। এর নিচে বসে ভাবছি, জীবনটা আসলে এত দৌড়ানোর নয়। মাঝে মাঝে থামতে হয়। নিজেকে ফিরে পেতে হয় প্রকৃতির কাছে।’
পদ্মা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হতাশা নিয়ে কথা বললেন স্থানীয় জেলে মো. রশিদ মিয়া। তিনি বললেন, কয়েক বছর আগেও পদ্মার ইলিশ, রুই, কাতলা ছিল খুবই প্রচুর। কিন্তু এখন নদীর পানি কমে গেছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে মাছও।
তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা এখন আগের মতো নেই। মাছ ধরার পেশা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে গেছে। পরিবারের পেট চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
পদ্মার বুকে চলছে মাছ ধরার নৌকা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জানতে চাইলে রাজশাহী নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. আবেদা সুলতানা বলেন, 'পাকশী ইউনিয়ন এখন দুই জগতের সন্ধিক্ষণে। একদিকে নদী ও কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবন, অন্যদিকে দ্রুত প্রসারমান শিল্পাঞ্চলের আধুনিকতা। এখানকার মানুষ তাই সংগ্রাম করেই গড়ে তুলছে তাদের স্বপ্নের ঘর।'
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী পাকশী কমিটির সহসভাপতি রঞ্জু ভৌমিক বলেন, 'কেউ গরু-মহিষ চরায়, কেউ ছোট নৌকায় মাছ ধরে, কেউবা মাটির চুলায় রান্না করে দিন কাটায়। পদ্মার বাতাসে ভেসে আসে তাদের জীবনের ঘ্রাণ। শত কষ্টের মাঝেও থেমে থাকে না তারা। বটগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চলে নতুন দিনের পথে।'
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'জীবন সহজ না। তবু এই মাটি, এই পদ্মা আমাদের সাহস দেয়। যতদিন এই গাছ, এই নদী আছে, ততদিন আমরাও আছি।'