নিজস্ব প্রতিবেদক

অনুমোদিত সংখ্যার বাইরে অতিরিক্ত পদোন্নতির ফলে সিভিল প্রশাসন এখন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৫০ জন পেয়েছেন অনুমোদিত পদের বাইরের (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতি।

বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে অতিরিক্ত পদোন্নতি প্রশাসনের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে, দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এবং ন্যায়বিচারহীনতা তৈরি করছে।

সাবেক সচিব ও গবেষক আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘এভাবে নির্বাচারি পদোন্নতি সিভিল সার্ভিসের মান ধসের অন্যতম কারণ। এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে কাঠামোগত পদ্ধতিতে পদোন্নতির আহ্বান জানান।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত আছেন ৩৮২ জন, অথচ অনুমোদিত পদ মাত্র ১২১টি। গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৪২ জন অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।

যুগ্ম সচিব পদেও একই চিত্র। অনুমোদিত ২৭২টি পদের বিপরীতে এখন ১ হাজার ৩৫ জন যুগ্ম সচিব দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে গত আট মাসেই ৪১৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

উপসচিব পদে বৈষম্য আরও প্রকট। ৩৫০টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে এখন কর্মরত আছেন ১ হাজার ৪০৪ জন।

সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অনেক সময় প্রকল্প পরিচালক বা দপ্তরের প্রধানের মতো ভূমিকা পালনের জন্য অতিরিক্ত পদোন্নতি দিতে হয়।’

কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, মন্ত্রণালয়গুলোতেও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কর্মকর্তা কাজ করছেন। উদাহরণ হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েই মাত্র দুটি অনুমোদিত পদের বিপরীতে এখন কর্মরত আটজন অতিরিক্ত সচিব।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগেও একই অবস্থা। মাত্র দুটি অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত ১১ জন অতিরিক্ত সচিব। এমনকি প্রশাসনিক শাখায় যুগ্ম সচিবের কোনো অনুমোদিত পদ না থাকলেও, এখন সেখানে সাতজন যুগ্ম সচিব কর্মরত।

সিভিল সার্ভিসের ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারই সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত পদোন্নতি পেয়েছে। পুলিশ, পররাষ্ট্র ও কর ক্যাডারও কিছু অতিরিক্ত পদোন্নতি পেয়েছে।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তাঁদের অভিযোগ, প্রশাসন ক্যাডারকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে বাকি ক্যাডারগুলোর প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে।

তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও প্রশাসন ক্যাডারকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। ৬ হাজার কর্মকর্তার জন্য বাকি ২৫ ক্যাডারের ৬০ হাজার কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।’

ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সুপারনিউমারারি পদোন্নতির প্রতিবাদ করেন। তারপরও প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি অব্যাহত রয়েছে।

জানুয়ারিতে শিক্ষা ক্যাডারের ৭৬৫ জন কর্মকর্তাকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে এবং শিগগিরই ৭ হাজারের বেশি চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।

কৃষি ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগে প্রশাসন ক্যাডার আমাদের পদোন্নতির বিরোধিতা করত। এখন বলে, 'আপনারা পদোন্নতি নেন, আমাদের বিরোধিতা করবেন না।'

তথ্য ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশ্বে আর কোথাও এমন প্রশাসন আছে কি না, সন্দেহ। এটা স্পষ্ট করদাতাদের অর্থের অপচয়।’