প্রতিনিধি মৌলভীবাজার

ঢেউতরঙ্গে চলছে নাচ। বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

খোলা মাঠ পার হয়ে দমকা হাওয়া আছড়ে পড়ছে গাছে গাছে। হাওয়ায় ঝুমুর নাচে দুলে উঠছে গাছের শাখা-প্রশাখা। বাতাস বৈশাখের ভ্যাপসা গরমকে তেতে উঠতে দিচ্ছে না। একটা মনোরম, মন ভালো করা বিকেল তৈরি হয়েছে গ্রামে। মাঠের মধ্যে কিছু ভ্রাম্যমাণ দোকান বসেছে। খেলনা ও প্রসাধনীর দোকান। আছে পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুভাজি, ঝালমুড়ি, চানাচুরসহ নানা রকম মুখরোচক খাবারের দোকানও।

বিকেলটা যত নুয়ে পড়ছে সন্ধ্যার দিকে, গ্রামের কাঁচা-পাকা পথ ধরে তত নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণীসহ নানা শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। শিশু, কিশোরী, তরুণী অনেকের খোঁপায় দুলছে ময়ূরের পেখমের মতো পালক। তারা অংশ নেবে নাচে, সে জন্য এ প্রস্তুতি। রঙিন হয়ে উঠেছে বিকেলটি। এই আয়োজন, ভিড় তৈরি হয়েছে একটি উৎসবকে ঘিরে। মণিপুরি জনগোষ্ঠীর একটি প্রাচীন ও তাৎপর্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ‘লাই হারাওবা’ বা ‘দেবতাদের আনন্দ’ উৎসব এখানে ডাক দিয়েছে সবাইকে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের তেতইগাঁওয়ে অবস্থিত মণিপুরি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে এমন ভিড় জমেছিল। আগের দিন তিন দিনের এই উৎসব শুরু হয়। এর পর থেকে চলছে নানা আচার-অনুষ্ঠান। শেষ হয় আজ শুক্রবার। এতে অর্থায়ন করেছে ইউনেসকো-আইসিএইচ, উৎসব বাস্তবায়নে ছিল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। সহযোগিতা ও পরিচালনায় ছিল আইসিএইচ পিডিয়া বাংলাদেশ (সিআইবি), সাধনা-দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির অগ্রগতি কেন্দ্র।

বিকেলটা ঘনিয়ে আসতে থাকলে জমে ওঠে মণিপুরি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণ। ক্রমে শ্রোতা-দর্শকে পূর্ণ হয়ে ওঠে শামিয়ানার নিচে পেতে রাখা খালি চেয়ারগুলো। আচার-অনুষ্ঠান, নাচে অংশ নিতে কুশীলবেরাও সক্রিয়, সচল হয়ে ওঠেন। ঢোল-খোল, বাঁশিসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের সুর বেজে ওঠে, প্রাঙ্গণজুড়ে চলতে থাকে সুরের ঝংকার। বাইরে সন্ধ্যার আঁধার নামলে উন্মুক্ত মঞ্চে উপস্থিত হন সমবেত শিল্পীরা। ক্রমে নারী, তরুণী ও শিশু-কিশোরীরা নৃত্যে অংশ নিতে থাকেন। গান ও সুরের তালে, নানা মুদ্রায় দীর্ঘ সময় ধরে নাচ চলতে থাকে। একটা সময় অনেকজনের অংশগ্রহণে উন্মুক্ত মঞ্চটি জলতরঙ্গের মতো দুলতে থাকে, ভাসতে থাকে। একদিকে খোলা হাওয়া, অন্যদিকে গান ও সুরের মূর্ছনা সন্ধ্যাটিকে প্রার্থনার মতো স্নিগ্ধ মুগ্ধতায় ডুবিয়ে রাখে।

ঢেউতরঙ্গে চলছে নাচ। বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

এথেনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (একডো) নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, লাই হারাওবা উৎসব মণিপুরি জনগোষ্ঠীর এক জীবন্ত ঐতিহ্য। এটি মণিপুরি জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে প্রাচীন ও পবিত্র উৎসবগুলোর একটি, যা প্রাচীন মেইতেই সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই উৎসব সৃষ্টিতত্ত্বকে উদ্‌যাপন করে এবং প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ককে তুলে ধরে।

এ উৎসব নিয়ে লক্ষ্মীকান্ত বলেন, লাই হারাওবা উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হলো মাইবিদের নৃত্য (মাইবি জাগোই), যেখানে মাইবি (নারী পুরোহিত) ঐতিহ্যবাহী ভঙ্গিমায় দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য নৃত্য পরিবেশন করেন। পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের চর্চা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরাই এই উৎসবের মূল লক্ষ্য।

‘লাই হারাওবা’ উৎসব আয়োজকদের সূত্রে জানা গেছে, মণিপুরি নৃত্যের আদিরূপ বলে বিবেচনা করা হয় ‘লাই হারাওবা জগোই’কে। ‘লাই’ শব্দের অর্থ দেবতা, ‘হারাওবা’ অর্থ আনন্দ, আর ‘জগোই’ হচ্ছে নৃত্য। এই অর্থে ‘লাই হারাওবা জগোই’ হচ্ছে দেবতাদের আনন্দময় নৃত্য বা দেবতাদের আনন্দ বিধানের জন্য নৃত্য পরিবেশনা।

পৃথিবী সৃষ্টি ও নৃত্যের উদ্ভব নিয়ে মণিপুরি সমাজে প্রচলিত একটি ‘মিথ’ আছে। সেই মিথে আছে পরম স্রষ্টা ‘অতিয়া মরু শিদাবা’ যখন পৃথিবী ও মানব সৃষ্টির পরিকল্পনা করলেন, প্রথমেই সৃষ্টি করলেন নয়জন ‘লাইবুংখৌ’ বা দেবতা এবং সাতজন ‘লাইনুরা’ বা দেবীর। সমগ্র বিশ্ব ছিল তখন জলময়। ‘শিদাবা মাপু’র নির্দেশে নয়জন দেবতা স্বর্গ থেকে মুঠো মুঠো মাটির ঢেলা নিক্ষেপ করতে থাকলেন। আর সাতজন দেবী সৃষ্টির অপার আনন্দে সেই বিশাল জলরাশির ওপর শুরু করলেন আনন্দময় নৃত্য। নৃত্যের তালে তালে স্বর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত মাটির ঢেলা সমতল হয়ে সৃষ্টি হলো পৃথিবীর এ বিশাল ভূখণ্ড।

লাই হারাওবা প্রচলনের সঠিক সময়কাল নির্দিষ্ট না হলেও অনুমান করা হয়, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মণিপুরি সমাজে লাই হারাওবা প্রচলিত। লাই হারাওবা সাধারণ কোনো নৃত্য নয়। কয়েক দিন ধরে অনুষ্ঠিত এ উৎসবে বিভিন্ন পর্যায়ে বিধৃত থাকে দেবতার উদ্বোধন, পৃথিবী সৃষ্টি, পৃথিবী ভ্রমণ, বসতি স্থাপন, গৃহনির্মাণ, শস্য বপন থেকে শুরু করে জন্ম-মৃত্যু অবধি বিস্তৃত মনুষ্য জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের বর্ণনা। লাই হারাওবা নৃত্যে প্রধান ভূমিকা থাকে মাইবা-মাইবীদের।

মাইবা-মাইবীরা হলেন প্রাচীন ধর্মের দেব-দেবীদের পূজা–অর্চনায় নিবেদিত পুরষ ও মহিলা। ‘লাই ঈকৌবা’ বা দেবতার উদ্বোধন দিয়ে শুরু হয় লাই হারাওবা নৃত্য। মাইবা পেনা (বাদ্যযন্ত্র) বাজান, মাইবী তার তালে তালে জলাশয়ে নিমজ্জিত দেবতাকে জাগ্রত করেন। দৈবাবিষ্ট হয়ে সেই দেবতাকে নিয়ে আসেন ও তার নৃত্যপূজা শুরু করেন। নৃত্যের মাধ্যমে মাইবী সৃষ্টিতত্ত্বের বিবরণ দেন। এমনিভাবে পর্যায়ক্রমে পরিবেশিত হতে থাকে লৈশেম জগোই (পৃথিবী সৃষ্টি), লৈনেৎ জগোই (সমতল ভূমির সৃষ্টি), লৈতা জগোই (বসতি স্থাপন), লৈমা জগোই (কুমারী নৃত্য)। লাই হারাওবা নৃত্য যদিও লোকনৃত্য পর্যায়ের, তবু লাই হারাওবা নৃত্যের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সময়ে নির্মিত হয়েছে মণিপুরি ধ্রুপদি নৃত্য।

লাই হারাওবা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ওইনাম লানথই জানিয়েছেন, লাই হারাওবা মণিপুরি জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রাচীন ও তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। এই উৎসব মণিপুরি সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক পরিচয়ের প্রাণকেন্দ্র, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয়ে আসছে। বিলুপ্তপ্রায় মণিপুরিদের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লাই হারাওবা সংরক্ষণ, লালন ও বিকাশে ইউনেসকোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। এটা সহনশীলতা ও বহুত্ববাদের চেতনায় লালিত বাংলাদেশের বর্ণময় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে মণিপুরিদের অবদান প্রদর্শন করছে।