প্রতিনিধি রাজশাহী

রাজশাহীর পবায় হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যবাহী দামকুড়া পশুহাট ১৬ বছর পর বুধবার পুনরায় চালু করা হয়েছে। দুপুরে ক্রতা–বিক্রেতাদের সমাগমে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

রাজশাহীর পবা উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী পশুর হাট দামকুড়া। উপজেলার দামকুড়া গ্রামের এই হাটে ১৬ বছর আগেও রমরমা কেনাবেচা হয়েছে। তখন হাটের নিলাম ডাক উঠত দুই কোটি টাকার বেশি। ২০০৮ সালের পর থেকে একটি সিন্ডিকেট এ হাটটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা নামমাত্র মূল্যে ডেকে নিয়ে ফেলে রাখত; কোনো পশু বেচাকেনা হতো না। ১০ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী সিটি হাটকে চালু করার জন্য এই তৎপরতাকে ‘চক্রান্ত’ বলে অভিযোগ এখানকার বাসিন্দাদের। দীর্ঘ ১৬ বছর পর উৎসবমুখর পরিবেশে আজ বুধবার সকালে দামকুড়া পশুহাট আবার চালু করা হয়েছে। আজ হাটের প্রথম ক্রেতা ও বিক্রেতাকে পুরস্কৃতও করা হয়েছে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী। তিনি হাটটি ১ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার ১১১ টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে এক বছরের জন্য ইজারা নিয়েছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আগের বছর হাটটি মাত্র ৩৬ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছিল ‘সিন্ডিকেট’। এর আগের বছর ইজারামূল্য ছিল ৩৭ লাখ টাকা। এক যুগের বেশি সময় ধরে একনাগাড়ে হাটটি এত দিন ইজারা নিয়েছিলেন রাজশাহী নগরের বাসিন্দা রেজাউনুর রহমান। তিনি রাজশাহী মহানগরের বোয়ালিয়া থানা (পূর্ব) আওয়ামী লীগের সভাপতি আতিকুর রহমানের ছেলে। তাঁরা একই সঙ্গে রাজশাহী নগরের সিটি হাটেরও ইজারাদার। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন।

আজ নতুন করে চালু হওয়া দামকুড়া পশুহাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উৎসাহিত করার জন্য গরুপ্রতি ৪০০ টাকা এবং ছাগলপ্রতি ১৫০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ পাশেই সিটি হাটে একটি গরুর ক্রেতার কাছ থেকে ৮০০ টাকা টোল আদায় করা হয়। আবার বিক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া হয় ২০০ টাকা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ছাগলের জন্য বিক্রয়মূল্যের ৫০ শতাংশ টোল আদায় করার কথা; কিন্তু দামকুড়া পশুহাটে মোটে ১৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

হাটের প্রথম গরু ও ছাগল ক্রেতাকে উৎসাহিত করা জন্য এক হাজার টাকা ও একটি ছাতা উপহার দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিক্রেতাকে কোনো টোল দিতে হয়নি বলে জানিয়েছেন পশুহাটের ইজারাদার শাহজাহান আলী। তিনি বলেন, ‘১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম দামকুড়া পশুহাটটি চালু হয়। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে কৌশলে দামকুড়া পশুহাটটি বন্ধ রাখা হয়েছিল। সপ্তাহে বুধ ও রোববার এই দুই দিন নগরের সিটি হাট ও দামকুড়া পশুহাট বসে। এই দুই হাটের বার একই হওয়ায় কৌশলে ইজারা নিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর বন্ধ রাখা হয়েছিল দামকুড়া পশুহাটটি। ফলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কাগজে–কলমে সবকিছু ঠিক থাকলেও প্রতিবছর প্রায় অর্ধকোটি টাকার রাজস্ব থেকে সরকারকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’

দামকুড়া পশুহাটে আজ মো. আশিক নামের এক ব্যক্তি প্রথম বিক্রেতা হিসেবে ৬ হাজার ৪০০ টাকায় একটি ছাগল বিক্রি করেছেন। ক্রেতা ছিলেন দামকুড়া গ্রামের মনসুর আলী। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে পুরস্কার পেয়েছেন এক হাজার টাকা ও ছাতা। ছাগল ক্রেতা মনসুর আলী বলেন, ‘আমি এই হাটের প্রথম ক্রেতা। ৬ হাজার ৪০০ টাকা দিয়ে একটি খাসি কিনে ছাতা ও ১ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছি। আমি অনেক আনন্দিত। এখন প্রচণ্ড গরমে খাসি কিনে ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।’

বন্ধ রাখা দুটি হাটের মধ্যে অপরটি ছিল মহিষালবাড়ী হাট। এটি রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার মধ্যে পড়েছে। ওই হাটটিও একইভাবে কম মূল্যে ইজারা নিয়ে ফেলে রাখা হতো। এবার ওই হাটটিও চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য অনুযায়ী, তিন দশক আগে বাংলা ১৪০১ সনে দামকুড়া হাটের ইজারামূল্য উঠেছিল ২ কোটি ৪ লাখ ৭৮৬ টাকা পর্যন্ত। একসময় মহিষালবাড়ী হাটও পৌনে দুই কোটি টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের পর থেকে এই হাট শুধুই ফেলে রাখা হতো।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দামকুড়া হাট থেকে ১০ কিলোমিটার ও মহিষালবাড়ী হাট থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী নগরে সিটিহাট নামের একটি পশুহাট চালু করা হয়। মহিষালবাড়ী হাট ও দামকুড়া হাট সপ্তাহে রবি ও বুধবার বসত। সিটি হাটটিও সপ্তাহের একই দিনে বসানো শুরু হয়। একপর্যায়ে প্রভাব খাটিয়ে দামকুড়া হাটে গরু-মহিষ তোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন পবা উপজেলার বিন্দারামপুর গ্রামের খবির উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি আদালতে মামলা করেন।

খবির উদ্দিন এর আগে বলেছিলেন, মামলা করার পর তখনকার ইজারাদার বাধ্য হয়ে হাট বসতে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১০ থেকে ১২টি হাট হওয়ার পরে তাঁরা ‘কৌশল করে’ দামকুড়া হাটটিও ইজারা নিলেন। কিন্তু বেচাকেনা দামকুড়া থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে সিটি হাটেই করতে থাকেন। দামকুড়া হাটে কোনো ব্যবসায়ীকে গরু-মহিষ তুলতে দেন না। ইজারা নেওয়া হাট তাঁরা ফেলে রেখেও যেহেতু সরকারকে রাজস্ব দেন, তাই আর কিছু বলার ছিল না।