[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

সাবেক ছাত্রদল নেতার মাটি ব্যবসায় হুমকির মুখে পদ্মাপাড়ের নিরাপত্তা

প্রকাশঃ
অ+ অ-

প্রতিনিধি রাজশাহী

পুকুরসমান গর্ত করে কেটে নেওয়া হচ্ছে পদ্মা নদীর পাড়ের মাটি। গত রোববার বেলা তিনটার দিকে রাজশাহীর চারঘাটের বড়াল নদের উৎসমুখের পাশে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মাপাড়ের মাটি কেটে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে ছাত্রদলের সাবেক এক নেতার বিরুদ্ধে। এতে একদিকে হারিয়ে যাচ্ছে চাষিদের ফসলের জমি, অন্যদিকে লাগাতার পাড়ের মাটি কেটে নেওয়ায় ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, বিজিবি ক্যাম্প, স্লুইসগেট, চারঘাট থানা, ভূমি অফিস, গুচ্ছগ্রামসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

এ ব্যাপারে ১৫ এপ্রিল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর অভিযোগ করেছেন বড়াল রক্ষা আন্দোলন ও চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্যসচিব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এস এম মিজানুর রহমান। এ ছাড়া ২৬ ফেব্রুয়ারি চারঘাটের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর বড়াল নদের উৎসমুখে পদ্মাপাড়ের মাটি কেটে বিক্রি করার ভয়াবহতা উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। এই প্রতিবেদনে এলাকাটি অবৈধ দখলদারের হাত থেকে উদ্ধার করে চারঘাটের ঐতিহ্য খয়েরবাগান সৃজন এবং একটি মিনি শিশুপার্ক নির্মাণের প্রস্তাব করেন।

উপজেলা ভূমি অফিসের প্রতিবেদন ও উপদেষ্টা বরাবর দাখিল করা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মাপাড়ের মাটি কেটে বিক্রি চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী মতলেবুর রহমান ওরফে মতলেব। তাঁকে সহযোগিতা করছেন উপজেলা বিএনপির একজন নেতা। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত এক্সকাভেটর (খননযন্ত্র) দিয়ে মাটি কেটে শত শত ড্রামট্রাকে বিভিন্ন ইটভাটা ও স্থাপনায় পাঠানো হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চারঘাট বাজারের স্লুইসগেট সংলগ্ন পদ্মা ও বড়াল নদের মোহনা বালুমহাল হিসেবে সরকার প্রতিবছর ইজারা দিত। কিন্তু বালু তোলার কারণে ক্যাডেট কলেজ, পুলিশ একাডেমিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ভাঙনের মুখে পড়ায় উচ্চ আদালতে মামলা চলমান থাকায় দুই বছর ধরে বালুমহালের ইজারা বন্ধ আছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বালুমহাল সংলগ্ন পদ্মাপাড়ের জায়গাগুলো নিয়ন্ত্রণে নেন যুবদল নেতা মতলেবুর রহমান। সেখান থেকে নদীপাড়ের মাটি কেটে বিক্রি শুরু করেন। স্থানীয় প্রশাসন সেখানে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করলেও মতলেব ও তাঁর লোকজন বালু তোলা বন্ধ করেননি।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেনের নেতৃত্বে মাটি কাটার জায়গাটি পরিদর্শন করেন। তাঁরা সেখানে সরকারি খাসজমির সঠিক সীমানা নির্ধারণ করে লাল পতাকা ও সাইনবোর্ড স্থাপন করেন। এ সময় জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্প ‘ইনোভেশনস ফর ক্লাইমেট-স্মার্ট আরবান ডেভেলপমেন্টের’ প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে নিয়ে ভাঙন রোধে সেখানে চারঘাটের ঐতিহ্যবাহী খয়েরগাছ রোপণের মাধ্যমে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়।

এদিকে ওই দিন দুপুরে গাছের চারা রোপণের পর রাত থেকেই আবারও মাটি কাটা শুরু হয়। মাটি পরিবহন করতে গিয়ে রোপণ করা গাছগুলোও নষ্ট করা হয়। সীমানা নির্ধারণের লাল পতাকা ও সাইনবোর্ড তুলে ফেলা হয়। এরপর স্থানীয় লোকজনের ফসল নষ্টের অভিযোগের ভিত্তিতে সর্বশেষ ১১ এপ্রিল বিকেলে সেখানে অভিযানে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। অভিযানে সহযোগিতায় ছিল মাত্র চারজন আনসার সদস্য।

ঘটনাস্থলে গিয়ে উপজেলা প্রশাসনের কর্মীরা এক্সকাভেটর মেশিন অকেজো করার চেষ্টা করলে সেখানে উপস্থিত হন মতলেবুর রহমানের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন দেশি অস্ত্রধারী। এ অবস্থায় যথেষ্ট ফোর্স না থাকায় অভিযান না চালিয়ে ফেরত আসতে বাধ্য হয় উপজেলা প্রশাসন। ওসি নিজে সেখানে উপস্থিত থাকলেও মাত্র ৩০০ মিটার দূরত্বে থেকেও ঘণ্টাখানেক সময়েও থানার পুলিশ ফোর্স সেখান উপস্থিত হননি।

প্রকাশ্যে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ওই এলাকায় যাওয়ার কোনো উপায় নেই। প্রশাসনের লোকজনকেই মাটি খননে জড়িত লোকজন ঘিরে ধরেন। তাই চারঘাটের মুক্তারপুর থেকে নৌকা নিয়ে পদ্মা নদী দিয়ে গত রোববার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভুট্টাখেতের পাশ থেকে নদীপাড়ের মাটি খনন করা হচ্ছে। ৩০-৪০ ফুট গভীরে মাটি কাটায় সমতল ভূমি থেকে যন্ত্রটির মাথা দেখা যাচ্ছে না। সেখানকার ছবি তুলতে দেখেই খাদের মধ্যে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন এই প্রতিবেদককে সালাম দেন। ছবি নিয়ে চলে আসতে গেলে একজন পেছন পেছন দৌড়ে আসতে থাকেন। ডাকতে ডাকতে বলেন, ‘ভাই, বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে যান, ভাই, বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে যান।’

স্থানীয় গোপালপুর এলাকার এক কৃষক বলেন, পদ্মা নদীতে অসময়েও ভাঙন চলছে। একের পর এক ফসল জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছেন আগামী বর্ষা মৌসুমের কথা চিন্তা করে। যেভাবে নির্বিচার নদীর পাড়ের মাটি পুকুরসমান গর্ত করে কাটা হচ্ছে, তাতে পুরো এলাকা নদীর মধ্যে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগে নদীর পাড়ে যেখানে ফসল ফলত, এখন সেখানে দুই মানুষ গর্ত হয়ে গেছে। যারা কাটছে তাদের বিরুদ্ধে কৃষকেরা প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না।

বড়াল আদর্শ গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, রাত হলেই শত শত ট্রাক নদীতে প্রবেশ করে। ট্রাকের শব্দে সারা রাত ঘুমানো যায় না। প্রতিটি ট্রামট্রাকের নদীর ভরাট মাটি পাঁচ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। তাতে প্রতি রাতে আনুমানিক পাঁচ-ছয় লাখ টাকার মাটি কাটা হচ্ছে। টাকা পাওয়ায় স্থানীয় বিভিন্ন বখাটে তরুণ সেই কাজের দলে যুক্ত হচ্ছেন।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে অভিযুক্ত যুবদল নেতা মতলেবুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভাই মাটি কাটছিলাম। প্রশাসন নিষেধ করে দিয়েছেন। বন্ধ করে দিয়েছি। আর মাটি কাটাব না। প্রশাসন অভিযান চালিয়ে আমার একটা গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ভাঙচুর করেছে। তাতে আমার লাখ দুয়েক টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর মাটি কাটাব না, ভাই। ওপরে যেটুকু ভরাট জমে ছিল, সেটুকু আমরা কেটেছি।’ আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আর কোনো কথা না। পরে কথা হবে বলে ফোন কেটে দেন।

মুঠোফোনে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, তাঁরা ১১ এপ্রিল অভিযান চালিয়েছেন। এরপর আর কোনো অভিযান চালানো হয়নি। মতলেবুর মিথ্যা কথা বলেছেন।

জানতে চাইলে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগ-২–এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ সরকার বলেন, পদ্মা নদীর ভাঙন রোধে চারঘাট উপজেলাজুড়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে পদ্মা-বড়ালের মোহনায় নদীপাড়ের মাটি কাটা হচ্ছে। এতে আগামী মৌসুমে এই এলাকাজুড়ে তীব্র ভাঙন হওয়ার আশঙ্কা হয়েছে। যেখানে মাটি কাটা হচ্ছে তার ২০০ মিটারের মধ্যে রয়েছে পুলিশ একাডেমি, চারঘাট থানা, ভূমি অফিস, স্লুইসগেট, বিজিবি ক্যাম্পসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন বলেন, নদীর প্রায় সাড়ে ৯ একর জায়গাজুড়ে মাটি কেটে বিক্রি করছে একটি চক্র। নদীপাড়ের পুরো জায়গাটি ৩০-৪০ ফুট গর্তে পরিণত হয়েছে। মতলেবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি মাটি কাটার এই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বারবার নোটিশ করে, সীমানা নির্ধারণের লাল নিশানা ও সাইনবোর্ড দিয়ে এবং বৃক্ষরোপণ করেও মাটি কাটা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। রাতের অন্ধকারে মাটি কাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। তবে মাটি কাটা বন্ধ করতে প্রশাসনের কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

ওই এলাকায় খয়েরগাছ রোপণ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) রাজশাহী জেলার সভাপতি জামাত খান। তিনি বলেন, আগামী ২৭ এপ্রিল নদী কমিশনের বৈঠক আছে। সেখানে এ বিষয়ে কথা বলা হবে। রাষ্ট্র যদি তারপরও কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে চারঘাট বাঘাসহ রাজশাহী জেলার সব উপজেলা এবং ইউনিয়ন থেকে লোক নিয়ে এই ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর কর্মসূচি পালন করা হবে।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন