প্রতিনিধি ব্রাহ্মণবাড়িয়া

আকরাম মিয়ার মৃত্যুর সংবাদে স্বজনদের আহাজারি। শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

‘ছেলে বলেছিল সে ক্লান্ত, এখন ঘুমাবে। কখন রাশিয়ার সেনারা ডাক দেয় বলা যায় না। ঘুম থেকে উঠে সকালে ফোন দিবে। কিন্তু ছেলে আর ফোন দেয়নি।’ বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের মোমেনা বেগম।

মোমেনা বেগমের ছেলে মোহাম্মদ আকরাম মিয়া (২২) রাশিয়ার পক্ষে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশি এক সহযোদ্ধা ফোন করে জানান, ইউক্রেন বাহিনীর হামলায় আকরাম নিহত হয়েছেন। এর পর থেকে কান্না থামছে না এই তরুণের মা–বাবার।

মোমেনা বেগম জানান, সর্বশেষ ১৩ এপ্রিল ছেলের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়। আর ১৪ এপ্রিল তাঁর ছেলে মারা গেছেন। তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ কথা বলার সময় ছেলে বলেছিল পালাবার কোনো সুযোগ নেই। পালালে গুলি কইরা মেরে ফেলবে। ছেলে সেখান থেকে ফিরতে পারবে না বুঝতে পেরেছিল।’

মোহাম্মদ আকরাম মিয়ার বাড়ি আশুগঞ্জের লালপুর ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আকরাম ছিলেন সবার বড়। পরিবারের আর্থিক সংকটে তাঁর পড়াশোনা দশম শ্রেণির পর আর এগোয়নি। ছোট বোন মারিয়া বেগমের (১৮) বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই মোহাম্মদ ফয়সাল (১৩) পঞ্চম শ্রেণিতে, বোন মারুফা আক্তার (৯) চতুর্থ শ্রেণিতে আর সবার ছোট ফাহিম মিয়া (৮) পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। তাদের বাবা মোরশেদ মিয়া কৃষিকাজসহ গরু লালন পালন করেন।

মোহাম্মদ আকরাম হোসেন | ছবি: সংগৃহীত

পরিবার জানায়, নরসিংদীর পলাশে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখেছিলেন আকরাম। বাবার ঋণের সাড়ে ছয় লাখ টাকায় দালালের মাধ্যমে রাশিয়ায় পাড়ি জমান তিনি। চীনা একটি প্রতিষ্ঠানে টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু জুটেছিল হেলপারের পদ। তা–ও ভালোই চলছিল তাঁর। কিন্তু দালালের প্রলোভনে পড়ে গত ৪ মার্চ রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন আকরাম।

পরিবার জানায়, চীনা প্রতিষ্ঠানে পাঁচ-ছয় মাস কাজ করেছিলেন আকরাম। ওই সময় দেশে চার লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন। রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর আর দেশে টাকা পাঠাতে পারেননি।

আজ শনিবার দুপুরে হোসেনপুর মধ্যপাড়ায় আকরাম মিয়ার বাড়ির সামনে স্থানীয় লোকজন ও স্বজনদের ভিড় দেখা গেছে। বাড়ির ফটকের বাইরে বাবা মোরশেদ মিয়া ও বোন মারিয়া বেগম বসা ছিলেন। ঘরে মা, ফুফুসহ স্বজনেরা আহাজারি করছিলেন আকরামের জন্য।

মোরশেদ মিয়া বলেন, এক দালালের প্রলোভনে পড়ে তাঁর ছেলে রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর ছেলেকে রাশিয়ার নাগরিকত্ব ও বিপুল পরিমাণ টাকার প্রলোভন দেখানো হয়। পাশাপাশি মাসে তিন লাখ রুবল (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা) বেতন দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। একপর্যায়ে তাঁর ছেলে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে অংশ নিতে তাঁর ছেলেকে ইউক্রেনে পাঠানো হয়। রুশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর তাঁর ছেলে বিষয়টি তাঁদের জানান।

মোরশেদ মিয়া বলেন, মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তাঁর ছেলেসহ ১২ জন একটি বাংকারে ছিলেন। ওই সময় বাংকারে হামলা হয়। হামলায় ময়মনসিংহের এক যুবক ও রাশিয়ার একজন সেনা নিহত হন। পাঁচ দিন পর বাংকার থেকে তাঁর ছেলেকে উদ্ধার করেন রাশিয়ার সেনারা। সেদিন ছেলে বলেছিলেন, ‘আমাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব না। তবে বাংলাদেশ সরকার যদি চায় তাহলে আমাদের ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব।’ তিনি আরও বলেন, ১৩ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে সর্বশেষ ছেলের সঙ্গে কথা হয়। আর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁর ছেলে সহযোদ্ধা ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আফজাল হোসেন (মেরাজ) ফোন করে ছেলের মৃত্যুর সংবাদ জানান।

ছেলের লাশ দেশে আনতে সহায়তার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান মোরশেদ মিয়া।

স্থানীয় লোকজন জানান, আকরামদের পরিবারের তিন শতক জায়গায় নির্মিত থাকার ঘরটাই একমাত্র সম্বল। সুদে ঋণ করে আকরামকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। এখন তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটি পুরো অসহায় হয়ে পড়ল।

স্থানীয় শামীম চৌধুরী বলেন, আজ শনিবার বেলা তিনটার দিকে আকরামের সহযোদ্ধা আফজাল হোসেনের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, আকরামের লাশ ইউক্রেন সীমান্তে আছে। তবে লাশ উদ্ধার হয়নি। তিনি বলেন, ‘আফজাল হোসেনও দেশে ফিরতে চান বলে জানিয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি নিহত আকরামের লাশসহ ওই যুদ্ধে আর কোনো বাংলাদেশি জড়ালে তাদের যেন দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়।’

পরে আজ বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে আফজাল হোসেনের মুঠোফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘আমি ইউক্রেনে আছি। তবে ইউক্রেনের ঠিক কোথায়, সেটি জানি না। লোকেশন দেখাচ্ছে না।’

আফজাল হোসেন বলে, ‘শুক্রবার লাশ উদ্ধারে যাওয়ার সময় আমার ওপর ড্রোন হামলা হয়েছে। সৌভাগ্যবশত বেঁচে গেছি।’ তিনি আরও বলেন, তাঁর সঙ্গে আর কোনো বাংলাদেশি নেই। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে ৪০-৫০ জন বাংলাদেশি লড়ছেন বলে তাঁর ধারণা।