প্রতিনিধি লালমনিরহাট
![]() |
লালমনিরহাট জেলা জামায়াত আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের কেন্দ্রীয় আমির শফিকুর রহমান। শনিবার দুপুরে লালমনিরহাট জেলা কালেক্টরেট মাঠে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘যেকোনো নির্বাচনের আগে অবশ্যই দুটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। একটি হচ্ছে, খুনিদের বিচার, এ বিচার দৃশ্যমান হতে হবে। আরেকটি হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার। এই দুইটা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না।’
আজ শনিবার দুপুরে লালমনিরহাট জেলা কালেক্টরেট মাঠে জেলা জামায়াত আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শফিকুর রহমান এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বারবার ঘোষণা দিয়েছেন, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বিনয়ের সঙ্গে বলব, আমরা নির্বাচন চাই, সুষ্ঠু নির্বাচন চাই; আমরা চুরিচামারি, কালোটাকার পেশিশক্তির প্রভাবযুক্ত নির্বাচন দেখতে চাই না। এই নির্বাচনের জন্য অবশ্যই সমতল মাঠ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) তৈরি করতে হবে। এই দায়িত্ব পালনের জন্য আপনারা যত রকম সহযোগিতা চান, সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত। বিচার আর সংস্কার এই দুটো অবশ্যই করে নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
আওয়ামী লীগের উদ্দেশে জামায়াতের আমির বলেন, ‘কোনো ফ্যাসিস্ট সরকার বিপ্লবী জনগণকে কোনোভাবে দাবিয়ে রাখতে পারে না। তারা (আওয়ামী লীগ) তেমনি বাংলাদেশের বিপ্লবী জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সাড়ে ১৫ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলন, ত্যাগ এবং কোরবানি—সবকিছুর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের যুব সমাজের নেতৃত্বে তারা গদি ছাড়তেই শুধু বাধ্য হয়, তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমরা বলি, এ দেশের সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নাগরিক যাঁরা, তাঁরা কখনোই দেশ থেকে পালানোর চিন্তাও করেন না। যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন, তাঁরা দেশ ছেড়ে পালান না। যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন, তাঁরা কানাডা, মালয়েশিয়ায় বেগমপাড়া গড়ে তোলেন না। যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন, তাঁরা দেশের টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করেন না। যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন, তাঁরা জনগণের করের টাকায় কেনা অস্ত্র আর গুলি জনগণের বুকে তাক করেন না। তাঁরা সবই করেছেন। ফ্যাসিস্টের শিরোমণি চেয়েছিলেন ফেরাউনের মতো এই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আল্লাহ যেভাবে ফেরাউনদের অতীতে বিদায় দিয়েছেন, এ দেশেও ফ্যাসিবাদের ধারক–হক যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অপমানজনকভাবে বিদায় নিয়েছেন। এমনকি যাওয়ার সময় নিজের সহকর্মীদেরও বলে যেতে পারেননি যে “আমি অমুক জায়গায় চলে যাচ্ছি।’
আওয়ামী লীগের শাসনামলের বিষয়ে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশকে একটি জীবন্ত কারাগারে পরিণত করা হয়েছিল। ভেতরের কারাগার থেকে বাইরের কারাগার ছিল আরও দুঃসহ। ভেতরের কারাগারে নতুন করে মামলা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। বাইরের কারাগারে থাকলে প্রতিনিয়ত বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী ও আলেম-ওলামাসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের, ধর্মের লোকের বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা চেয়েছিলেন, মামলা করে, হামলা করে, খুন করে, গুম করে, আয়নাঘরে বন্দী করে এই বাংলাদেশের মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেবেন। এভাবে মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায় না। দাবিয়ে রাখতে পারেননি।’
শফিকুর রহমান সীমান্তে মানুষ হত্যা ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের উত্তরের লালমনিরহাট জেলা একটি দূরবর্তী বর্ডার এলাকা। এই বর্ডার এলাকায় দুই তিন দিন আগে, আমাদেরই এক সন্তান হাসিনুর রহমান, সে একজন অতি সাধারণ শ্রমিক, এক ভাই এক বোনের সংসার। সে গিয়েছিল (সীমান্ত এলাকায়) গবাদিপশুর জন্য ঘাস কাটতে, সেখানে তার বুকের ওপর পা রেখে (বিএসএফ) ঠান্ডা মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। খুন করে তার লাশটি টেনেহিঁচড়ে ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করি, সে কি মানুষ ছিল না? যারা হত্যা করেছে, ওরা কি মানুষ নয়? কীভাবে তারা ঠান্ডা মাথায় সীমান্ত পেরিয়ে এখানে এসে মানুষকে হত্যা করতে পারে? এটি তো একটি স্বাধীন দেশ। আমাদের বিজিবি যারা আছে, তারা কি ওই পারে গিয়ে এগুলো করে? কারণ, আমরা তাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। এবং তাদের সম্মান দেখাই। সেই সম্মানটুকু বাংলাদেশের জনগণের পাওয়ার অধিকার আছে। আমরা ৫৩ বছর সেই অধিকার পাইনি। আমাদের দাবিয়ে রাখা হয়েছে। আধিপত্যবাদের কালো ছায়া আমাদের ঘাড়ের ওপর ছিল। আমরা এ ছায়া দেখতে আর দেখতে চাই না।’
জামায়াতের আমির আরও বলেন, ‘ইন্ডিয়া আমাদের প্রতিবেশী দেশ। তাঁদের সঙ্গে আমরা সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমতার ভিত্তিতে আমরা প্রতিবেশী হিসেবে এখানে বসবাস করতে চাই। আমরা ভালো থাকলে তাঁরা ভালো থাকবেন, আমাদের ভালো কেড়ে নিলে তাঁরাও ভালো থাকবেন কি না, তাঁদের চিন্তা করতে হবে। আমরা দেখতে চাই, আমরা উভয় ভালো থাকব—সেই পরিবেশ ইন্ডিয়াকে নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। তিস্তার কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম আসলেই উত্তর জনপদের মানুষ আতঙ্কে থাকে। কী হবে আজ আমাদের কপালে। তিস্তা পাড়ের মানুষ ভালো করে একটা ঘরবাড়িও তৈরি করে না। কারণ, তারা বন্যার স্রোতে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এই দুঃখ মুছে যাক আমরা চাই। এ জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা কোনো ধরনের চোখ রাঙানোর তোয়াক্কা না করে, গড়িমসি না করে, অবিলম্বে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। লালমনিরহাটে ব্রিটিশ আমলের নির্মিত একটি বিমানবন্দর রয়েছে, সেটা চালু করতে হবে।’
এই জনসভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা মমতাজ উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাহবুবুর রহমান বেলাল প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন লালমনিরহাট জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য মো. আবু তাহের।