প্রতিনিধি নড়াইল
![]() |
মা কাজল রানির সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরছেন মধু মহালদার। শুক্রবার সকালে নড়াইল সদর উপজেলার শোলপুর গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দরিদ্র পরিবারে জন্মের এক বছর পর রোগে আক্রান্ত হন মধু মহালদার। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় তাঁর দুই পায়ের মাংস। চিকিৎসার অভাবে একপর্যায়ে দুটি পা অকেজো হয়ে যায়, বরণ করেন স্থায়ী পঙ্গুত্ব। এর পর থেকে হামাগুড়ি দিয়েই জীবনের ৩৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি।
মধু হালদারের (৩৫) বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার শোলপুর গ্রামে। মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচসহ সংসারের ভার পুরোটাই একা মধুর ঘাড়ে। তাই অসুস্থতাকে সঙ্গী করেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মধু। তবে পরিশ্রমের সঠিক মূল্যায়ন পান না বলে দাবি তাঁর।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, মধু মহালদার রোগে আক্রান্তের একই বছর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান তাঁর বাবা পেরমত মহালদার ও একমাত্র বড় বোন কবিতা মহালদার। এর পর থেকে মা কাজল রানি বহু কষ্টে তাঁকে লালনপালন করেন। তবে অর্থাভাবে মধুর উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেননি। একটু বয়স হলেই অভাবের সংসারের হাল ধরতে কাজে নামতে হয় মধুকে। পড়াশোনা শেখার বয়সে তাঁকে শিখতে হয় চাষাবাদ। সেই থেকে অন্যের খেতখামারে কাজ করেই মাকে নিয়ে মধুর সংসার চলতে থাকে।
![]() |
গরুকে খড় দিয়ে গোয়াল থেকে বের হচ্ছেন মধু মহালদার। শুক্রবার সকালে নড়াইল সদর উপজেলার শোলপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আক্ষেপ করে মধু মহালদার বলেন, ‘এক বছর বয়স থেকে দুই পা নড়েই না। সেই থেকে হামাগুড়ি দিয়ে চলি। বাবা তখনই মারা যায়। মা কষ্ট করে আমারে বড় করিছে। ছোটবেলায় খেলাধুলা, পড়াশোনা করতি পারিনি, সংসারের হাল ধরতি হয়ছে। কৃষির সব কাজ পারি—চাষ, রোপণ, কাটন—সবই করি হাতের জোরে। কিন্তু শুধু এই শরীরটাই দেখেই লোকে কম টাকা দেয়। অন্যদের সমান কাজ করি, কিন্তু স্বাভাবিক শ্রমিক ৫০০ পাইলে, আমি পাই আর্ধেক—২৫০ টাকা।’
মধু বলেন, ‘যে কটা টাকা আয় করি, তাতে এই বাজারে পাঁচজনের মুখে দুই বেলা ভাত তোলাও কঠিন। চাল কিনলে তরকারি থাকে না, ছেলেমেয়ের খাতা কিনলে মায়ের ওষুধ ফেলে রাখতে হয়। সংসার এমন এক ছেঁড়া চাদর, এক পাশ টানলে আরেক পাশ খোলাই পড়ে থাকে।’
সন্তানের এই জীবনসংগ্রাম দেখে কাঁদে মায়ের মন। ছেলেকে নিয়ে কাজল রানি বলেন, ‘বয়স তো অনেক হইছে মধুর। বাপ মরেছে ছোটকালে। সে বেঁচে থাকলে মধুর এত কষ্ট করা লাগত না। আমার মধু অন্যের জমিতে কামলা খাটে হামাগুড়ি দিয়ে। সংসার চালায় কষ্টে কষ্টে। আমরা গরিব, পরিবার থেকেও কিছু দিতে পারি না ওকে। যদি কোনো জায়গা থেকে একটা মোটরচালিত হুইলচেয়ার পাইত, তাহলে ওর একটু কষ্ট কমত।’
![]() |
টাকা কম আয় করলেও কখনো কারও কাছে হাত পাতেন না মধু | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
টাকা কম আয় করলেও কখনো কারও কাছে হাত পাতেন না মধু। এটিই মধুর বড় গুণ উল্লেখ করে প্রতিবেশী চাচা সুজয় গাছি বলেন, ‘মধু খুবই ভালো ছেলে। সে খুব কষ্টে জীবিকা নির্বাহ কর। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে দিন কাটায়। তবু সে কারও কাছে হাত পাতে না, ভিক্ষা করে না।’
রেজাউল হক নামে এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘মধু প্রতিবন্ধী হলেও নিজেকে সমাজের বোঝা মনে করে না। প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করেই হামাগুড়ি দিয়ে মাঠে কাজ করে সংসার চালায় সে। আমরা চাই, সে শ্রমের সঠিক মূল্য পাক। তাকে যেন কেউ না ঠকায়।’
নড়াইল সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা উত্তম সরকার বলেন, মধুর সংগ্রামী জীবন অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। প্রতিবন্ধী হয়েও তিনি যে সুষ্ঠু-স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, এটা অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। ইতিমধ্যে মধু মহালদারের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরা চেষ্টা করছেন, আরও কোনো কর্মসূচির আওতায় তাঁকে সহযোগিতা করার।