[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

ফেল করা সন্তানকে স্পর্শ করুন, বুকে জড়িয়ে ধরুন

প্রকাশঃ
অ+ অ-

বোর্ডে টাঙানো এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল দেখছে শিক্ষার্থীরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

খান মো. রবিউল আলম: এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। পাসের শতকরা ৮৩.০৪ ভাগ। অর্থাৎ ১৬.৯৬ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। কেবল তা–ই নয়, প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ, দেশের ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি।

যারা ফেল করেছে, তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে জীবন কত কঠিন। পাস-ফেল কী বিষয়। কী কালো মেঘ তাদের ওপর ভর করছে। অনুভব করছে ফেল করা মানেই প্রত্যাখ্যাত হওয়া। আর প্রত্যাখ্যান মানেই দীর্ঘ বিস্বাদ-হতাশা। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া–প্রতিবেশী কারও কাছেই আজ তারা সম্মানিত তা আদরণীয় নয়। কারণ, এ সমাজ সফলদের বরণ করে, ব্যর্থদের নয়।

২০০৯ সাল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী পরিচালিত গণসাক্ষরতা অভিযানে কাজ করি এবং এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই।

গণসাক্ষরতা অভিযান ২০০৯ সালে জুলাই মাসে এসএসসি পরীক্ষায় ফেল শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকায় একটি সম্মেলন করে। এ সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল—শিক্ষার্থীদের ফেল করার কারণ ও উত্তরণের উপায় অনুসন্ধান। প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীদের ফেল করার পেছনে প্রায় ২০-২৫টি কারণ চিহ্নিত করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমূল হক সম্মেলনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করে মন্তব্য করেন, পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর ফেল করার পেছনে রয়েছে চতুর্মুখী কারণ। এই চতুর্মুখী কারণ হলো স্কুলের পক্ষ থেকে অবহেলা, শিক্ষকের অদক্ষতা, অভিভাবকের অসচেতনতা এবং শিক্ষার্থীর সক্ষমতার অভাব।

অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ফেল করার পেছনে তাদের দায় ২৫ ভাগ আর শিক্ষা সুশাসনের দায় ৭৫ ভাগ। শিক্ষার কাঠামোগত ব্যর্থতার দায় পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। এসব শিক্ষার্থী সাধারণত প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত এবং নানা রকমের প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে জীবন বয়ে নেয়। তবে এসব প্রতিকূলতার ভেতর থেকেও কেউ কেউ যে বেরিয়ে আসছে, না তা নয়। এদের আমরা অদম্য হিসেবে চিনি।

ফেল করার পেছনে যেমন বড় কারণ থাকে, তেমনি থাকে ছোট কারণ। যেমন সেই সম্মেলনে কিছু শিক্ষার্থী বলেছিল, পরীক্ষার আগে আগে তারা বাবা-মাকে হারিয়েছে। ফলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। দু-একজন বলেছিল, তাদের মা-বাবার মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। কয়েকজন কন্যাশিক্ষার্থী জানিয়েছিল, দশম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকে তাদের ওপর বিয়ের চাপ ছিল। এ মানসিক চাপ নিয়ে তারা স্থিরভাবে পড়াশোনা করতে পারেনি। ফেল করা শিক্ষার্থীদের বর্ণনা এত মর্মস্পর্শী ছিল যে মঞ্চে উপস্থিত অতিথিদেরসহ অনেকের চোখে পানি ধরে রাখা সহজ ছিল না।

মানুষ মূলত সফলদের গল্প শুনতে অভ্যস্ত। ব্যর্থদের গল্পে থাকে কম আসক্তি। কিন্তু তথাকথিত এসব ফেল করা শিক্ষার্থীর গল্প অনেকের কাছে ছিল আলোকবর্তিকাস্বরূপ। কারণ, অ্যালেক্স হেলি তার ‘রুটস’ উপন্যাসে বলেছেন, যথাযথভাবে নির্মিত হলে কেবল বিজয়ী নয়, বিজিতদের ইতিহাসও মহত্তর হতে বাধ্য। সত্যি আমরা যদি ফেল করা শিক্ষার্থীদের কথা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনি, তবে তাদের মধ্যে তৈরি হবে দায়বদ্ধতা।

অবশ্য জীবনের শুরুতে ফেল করা সব সময় মন্দ নয়। ফেলের ওপর বিশেষত ফেল ম্যানেজমেন্টের ওপর দুনিয়াজুড়ে অনেক ভালো কাজ হয়েছে। যেমন ফেইল ফাস্ট, ফেল ওফেন: হাউ লুসিং ক্যান হেল্প ইউ উইন বইটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ফেল ম্যানেজ করে কীভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, সে বিষয়ে অনেক মোটিভেশনাল কথাও শোনা যায়। যেমন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টল চার্চিল একবার বলেছিলেন, সাকসেস ইজ নট ফাইনাল, ফেইলর ইজ নট ফ্যাটাল, ইট ইজ দ্য কারেজ টু কনটিনিউ দ্যাট কাউন্টস (সফলতা চূড়ান্ত কথা নয়, ফেল করাটাও মারাত্মক কিছু নয়; মোদ্দা কথা হলো প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা)।

ইউএনডিপিতে কাজ করার সময় ইনোভেশন বিষয়ে এক কর্মশালায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কর্মশালায় উদ্ভাবকেরা নতুন নতুন মডেল উপস্থাপন করছিলেন। এ সময় ইউএনডিপির তৎকালীন ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর নিক ব্রোসফোর্ড বললেন, কোনো নতুন মডেলটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা দ্রুত ফেল করব, তা দেখাতে হবে। আরও বললেন, দ্রুত ফেল করতে হবে এবং মাঝেমধ্যে ফেল করতে হবে; তবেই এগোনো যাবে। কথাটি শুনে ভিরমি খেলাম। ভদ্রলোক বলেন কী?

যে সমাজে সবাই পাস করতে চায়, চ্যাম্পিয়ন হতে চায়, সেখানে তিনি দ্রুত ফেল করার বিষয়টিকে উৎসাহিত করছেন; নিশ্চয় এর পেছনে কোনো কারণ রয়েছে। আমি হাত তুলে বললাম, তোমার কথাটি বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে বলো, বললেন—দেখো, একটি প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে ফেল করা মানে সময় এবং অর্থ দুটোরই সম্পূর্ণ লস; কিন্তু যদি শুরুর দিকে ফেল করো, তাহলে লসের পরিমাণ কমে আসবে, সফলতার জন্য জুতসই কৌশল নির্ধারণ করতে পারবা।

উপলব্ধি করলাম, কথাটির দার্শনিক মূল্য আছে। ফেল তো জীবনের অপরিহার্য অংশ। সবাই জীবনে কোনো না কোনো সময় ফেল করে। সফলতা ও ব্যর্থতার অনুভব নিয়ে জীবন চালিয়ে নেয়। বলা যায়, সাফল্যের তুলনায় ব্যর্থতার পাল্লা কোনো অংশে কম নয়।

ফেল পদ্ধতিগতভাবে ম্যানেজ করা শেখার বিষয়। কারণ, উইনার টেক অল (অর্থাৎ যে জয়ী হয় সে সবকিছু নিয়ে যায়)। যেমন জিপিএ–৫ বা গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ফেসবুকের পুরো পেজ আজ নিয়ে গেছে। তবে নিয়ত ফেল করতে থাকলে তো আর কিছু পাওয়া যাবে না। কিছু পেতে হলে ফেল জয় করতে হবে।

ফেল বিষয়ে সামাজিক বোঝাপড়াও খুব নিদারুণ। ফেলকে দেখা হয় সর্বস্বান্ত হওয়া হিসেবে। ধরে নেওয়া হয় এটি দাঁড়িসূচক। আগামীর গন্তব্য শেষ। আমার নিজস্ব পরিসরের মধ্যে জীবনে ফেল করা দুজনকে জানি, যাদের একজন পড়ান আমেরিকার বার্কলিতে, আরেকজন সিয়াটলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফেল নানাভাবে আলোকিত করতে পারে এ বোধটুকু থাকা দরকার। জীবন নিয়ে গভীর উপলব্ধি দরকার। এক ফেল আর এক পাস জীবনের শেষ নয়।

যেসব শিক্ষার্থী ফেল করেছে, তাদের সব শেষ হয়ে যায়নি। তারা জীবনের শুরুতেই ফেল করেছে মানে তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অফুরন্ত সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তারা জয় নয়, পরাজয়ের স্বাদ নিয়ে পথচলা শুরু করেছে। পরাজয়ের ভেতর জয়ের বীজ লুকিয়ে থাকে। জয় হলো শীর্ষবিন্দু আর পরাজয় শুরুর বিন্দু।

তবে বিষয়টি যত সহজে বলা হচ্ছে, তত সহজ নয়। কারণ, কোনো বিষয়ে ফেল করলে বা ফেল করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে মানুষ আতঙ্কিত বা ভিতু হয়ে পড়ে। ওরিয়েন্টালিজমখ্যাত লেখক এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, যেকোনো ভীতিকর বাস্তবতা মোকাবিলায় মানুষের জ্ঞান অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও মানুষ দম নেয়, আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

ফেল করা শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনা অঙ্কুরে নষ্ট করা যাবে না। তাদের দিয়ে কিছু হবে না, এমন মনোভাব দেখানো যাবে না। হুমকি বা ভয়ভীতি বন্ধ করতে হবে। দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বুঝতে দিতে হবে, আপনি তার পাশে আছেন। স্নেহ ও ভালোবাসার ছায়া প্রসারিত করছেন। এ ক্ষেত্রে পরিবার, বাবা-মা, পাড়া–প্রতিবেশীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করেছে, তাদের ফেল করা বন্ধুদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তবেই বোঝা যাবে তারা সাফল্যের মর্মবাণী ধারণ করেছে।

পিতা-মাতা, ভাই–বোন, নিকটাত্মীয়দের পক্ষে সম্ভব হলে ফেল করা শিক্ষার্থীটিকে একটি উপহার দিন, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যান ও তার পছন্দের খাবার খাওয়ান। ফেল করা সন্তানকে স্পর্শ করুন, বুকে নিন। নিশ্চিত থাকুন, সন্তানটি ৩৬৫ দিন পর আপনাকে খুশির খবর দেবে। নিরাশ হবেন না। জার্মান কবি গ্যেটে বলেছেন, আশাবাদী মনোভাব হতাশার চেয়ে কল্যাণকর।

সফলদের অভিনন্দন। আর যারা আপাতত সফল হতে পারোনি, তাদের জন্য শুভকামনা।

লেখক: যোগাযোগ পেশাজীবী ও শিক্ষক

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন