মেগাপ্রকল্প শেষ হলে নির্মাণকর্মীরা কোথায় হারিয়ে যান?

পদ্মাসেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকেরা। এরমধ্যেই অনেক মেগাপ্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, বা শেষ হওয়ার কাছাকাছি রয়েছে। ফলে হাজার হাজার শ্রমিক এখন নতুন কর্মসংস্থান খুঁজছেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সাদিকুর রহমান: পদ্মাসেতুর সাথে সংযোগ স্থাপন করা দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে এন-৮ নির্মাণকাজের কর্মী ছিলেন মেহেদি হাসান (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি তাঁকে দেখা যায় ঢাকায় রিক্সা চালাতে ।

খুলনার একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী এই যুবক এন-৮ এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে কাজ করার সময় বিদেশ যাত্রার চেষ্টাও করেন। তবে কিছু অসাধু দালালের প্রতারণার শিকার হয়ে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।  

মেহেদি বলেন, 'আমার ছয় মাস বয়সী বাচ্চাটার চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার, তাই এখন রিক্সা চালাই। নতুন একটি নির্মাণ প্রকল্পে চাকরির চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তাঁরা যে মজুরির কথা বলে, সেটা একজন রিক্সাচালকের দৈনিক আয়ের চেয়ে বেশি ছিল না।'

সুবৃহৎ কিছু অবকাঠামো নির্মাণকাজে একই রকম ভেস্ট, হেলমেট ও বুট পরা নির্মাণকর্মীদলের দিনের পর দিন অক্লান্ত কর্মকাণ্ড– গত এক দশকে বাংলাদেশে এক সুপরিচিত দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। এরমধ্যেই অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, বা শেষ হওয়ার কাছাকাছি রয়েছে। ফলে হাজার হাজার শ্রমিক এখন নতুন কর্মসংস্থান খুঁজছেন।

অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে এদেরমধ্যে অনেকেই বিদেশে পারি জমানোর চেষ্টা করেছেন, তবে যথাযথ চ্যানেলে এই চেষ্টা না করায়, অনেকেই অসাধু দালালদের খপ্পড়ে পড়ছেন।  

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মেগাপ্রকল্পে কাজ করার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকায় বিদেশ দক্ষ বা আধা-দক্ষ কর্মী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার উপযুক্ত প্রার্থী এসব কর্মী– তবে স্থানীয় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তাঁদের চেয়ে অদক্ষ শ্রমিক পাঠাতেই বেশি আগ্রহী। কারণ, অদক্ষ শ্রমিকদের সহজেই প্রতারিত করে টাকা-পয়সা নিতে পারে তাঁরা।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সাবেক একজন পরিচালক ড. মো. নুরুল ইসলাম বলেন, দক্ষ এসব নির্মাণ শ্রমিককে (শ্রম রপ্তানিতে) যথাযথভাবে ব্যবহারের সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। 


তিনি বলেন, 'উন্নত দেশগুলোর মতোন– কর্মসংস্থান বিনিময়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকায়– উচ্চ দক্ষতা থাকার পরেও অনেক শ্রমিক নতুন নির্মাণকাজে নিয়োগ পাচ্ছে না। সরকারি বা বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানেই এই চর্চা নেই। অথচ বাংলাদেশ শ্রম উদ্বৃত্ত একটি দেশ, বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা।'  

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি)-র দক্ষিণপশ্চিম কোণে সম্প্রতি কিছু কর্মীকে দেখা যায় তেজগাঁও-কমলাপুর রেলপথের সমান্তরালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার স্থাপন করতে।   

সাইটের ক্রেন অপারেটর আলমগীর হোসেন এর আগে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন মেঘনা-গোমতী সেতু প্রকল্পে। এরপর তিন বছর বিরতির পরে চলতি বছর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে কাজ শুরু করেছেন আলমগীর।  

আলমগীর বলেন, 'দুবাই যাওয়ার জন্য দরকারি টাকাপয়সা যোগাড় করতে গত তিন বছরে নিজ এলাকায় একটা ব্যবসা করতাম। কিন্তু, তাতে সফল হইনি। তবে মেঘনা-গোমতী সেতু প্রকল্পে আমার সাথে কাজ করতো এমন অন্তত তিনজন দুবাইয়ে চাকরি পেয়েছে।'  

স্থানীয় মেগাপ্রকল্পগুলোয় কর্মরত শ্রমিকরা সাধারণত দৈনিক ১০ ঘণ্টার শিফটে কাজ করে, মজুরি পান ৫৫০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। এরমধ্যে পাঁচ বছর বা তার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্নরা সর্বোচ্চ মজুরি পান।'

আরেকজন ক্রেন অপারেটর কবির হোসেন বলেন, এর আগে তিনি পদ্মাসেতু এবং ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পেও কাজ করেছেন। তিনি বলেন, 'দক্ষতা থাকা গুরুত্বপূর্ণ, তবে নির্মাণকাজের সাইটে নিয়োগ পেতে দালালদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকাটাই পূর্বশর্ত।'

ব্যাখ্যা দিয়ে কবির বলেন,  বিদেশিরাই এসব প্রকল্পের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনা করে, সেখানে যারা দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন, তাঁরা দালাল হিসেবেও কাজ করেন।   

পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ অন্যান্য প্রকল্পে কাজ করা শ্রমিকদের বিদেশে আরও উচ্চ দক্ষতার কাজ পাওয়ার মতো– যথেষ্ট বাস্তবিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে মনে করেন বিএমইটি'র সাবেক পরিচালক ড. মো. নুরুল আমিন নুরুল ইসলাম।   

তিনি বলেন, 'রিক্রুটিং এজেন্ট হলে আমি ভোকেশনাল ট্রেনিং এর সনদ থাকা শ্রমিকের চেয়ে– বাংলাদেশে মেগাপ্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মীকেই অগ্রাধিকার দিতাম, তার প্রথম কারণ– আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এসব কর্মীরা আসলে দক্ষ। তাঁরা অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে বেশি আয়, এবং রেমিট্যান্স পাঠাবে।'  

নুরুল ইসলাম জানান, মধ্যপ্রাচ্য ও উন্নত দেশগুলোয় দক্ষ রাজমিস্ত্রী, প্লাম্বার, কাঠমিস্ত্রী, ওয়েল্ডার, রড বাইন্ডার ও ভারী যন্ত্রপাতি (যেমন ক্রেন বা এক্সকেভাটর) অপারেটরদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। তবে তাদের কর্মসংস্থানের নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস নেই, বিশেষত স্থানীয় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দক্ষ শ্রমিকদের নিয়োগের নোটিশ তেমন একটা প্রকাশ করে না।    

রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিদেশে কর্মসংস্থান চাহিদার তথ্য যোগাড় করে সেগুলো স্থানীয় গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকারে দিতে পারে। বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশের দুতাবাসগুলোও এসব তথ্য যোগাড় করে সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিকে দিতে পারে। তখন তারা এগুলো স্থানীয় পর্যায়ে প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারবে। 'কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সংশ্লিষ্ট কোন সংস্থাই এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে করেনি।'

বিশেষত বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'প্রাইভেট এজেন্সিগুলো অদক্ষ কর্মীদেরি পছন্দ করে, কারণ তাঁদের থেকেই বেশি টাকা আয় করতে পারে। একইসঙ্গে তাঁরা এসব কর্মীর কোনো দায়দায়িত্বও নেয় না।'

অথচ, বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে নেই কোন সমস্যা। বেশিরভাগক্ষেত্রে বিদেশি নিয়োগদাতারাই এসব কর্মীর ভ্রমণ খরচ বহন করে। ফলে অভিবাসী এসব কর্মীকে প্রতারিত করার সুযোগ তেমন থাকে না দালালদের। নুরুল ইসলাম বলেন, 'দক্ষ কর্মীরা শুধু বেশি বেশি রেমিট্যান্স আয় করেন তাই-ই নয়, বরং তাঁরা দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেন।'

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনশক্তি রপ্তানির মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশ হলেন দক্ষ কর্মী। 'দক্ষ নির্মাণকর্মীরা যদি সঠিক চ্যানেলে বিদেশে যেতে পারেন, তাহলে এটি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে'- যোগ করেন তিনি।