প্রতীকী ছবি

প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জ: গৃহবধূ বেলী খাতুনের স্বামী অন্যের বাড়িতে দিনহাজিরা চুক্তিতে কৃষাণের কাজ করেন। কর্মস্থলের মালিক তার পরিবারের সঙ্গে কৃষাণের পরিবারকেও গত কুরবানির ঈদের ছুটিতে কুয়াকাটায় বেড়াতে নিয়ে যান। আর গরিবের এই বেড়াতে যাওয়াটাই কাল হয়েছে।

চল্লিশোর্ধ্ব বেলী খাতুন কুয়াকাটায় গিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন- এমন অপবাদ দিয়ে গ্রামে রীতিমতো সালিশ বসিয়ে এই ‘অপরাধের’ জন্য জরিমানা করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা।

জরিমানার টাকা দিতে না পারায় দরিদ্র পরিবারটিকে এক সপ্তাহ ধরে সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে। গ্রামের পক্ষ থেকে পালা করে পাহারা বসিয়ে পরিবারটির ওপর নজরদারিও করা হচ্ছে। এ অবস্থায় অসহায় দরিদ্র পরিবারটি মানবেতর জীবনযাপন করছে।

অপর গৃহবধূ বিউটি খাতুনের ক্ষেত্রেই প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে। তাকেও ওই সালিশ ডেকে ‘চরিত্রহীন’ ও ‘মূর্তি ব্যবসায়ী’ আখ্যা দিয়ে করা হয়েছে একঘরে। তাকেও একই অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অবশ্য তিন দিন পর ১০ হাজার টাকা সমাজপতিদের হাতে তুলে দেয়ায় তার ‘শাস্তি’ শিথিল করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার তালম ইউনিয়নের গাবরগাড়ি গ্রামে ঘটেছে এমন বর্বর ঘটনা। তবে ঘটনার এক সপ্তাহ পার হলেও প্রশাসন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি।

সরেজমিনে দেখা যায়, চরিত্রের ত্রুটি আছে- এমন অভিযোগ এনে গাবরগাড়ি গ্রামে দুই নারীকে এক সপ্তাহ ধরে সমাজচ্যুত করে রেখেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্যের নেতৃত্বে কতিপয় গ্রাম্য মাতব্বর। আর ওই নারীরা সমাজচ্যুত হওয়ার পর থেকে গ্রামের কারও কথা বলতে পারছেন না। পারছেন না কএনা বাড়িতে বা বাজারে যেতে। লোকলজ্জায় ঘরের কোণে বসে চোখের জল ফেলছেন শুধু।

ভুক্তভোগী পরিবার ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানা যায়।

‘গাবরগাড়ি গ্রামে পরস্পর স্বজন দুই নারী রাত করে বাড়ি ফেরেন। আবার মাঝেমধ্যেই বেড়াতে যান এখানে-সেখানে। এটা চারিত্রিক ক্রটির অংশ।’- মাস দুয়েক আগে গাবরগাড়ি গ্রামের মোড়লদের কাছে এমন অভিযোগ করেন ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা।

তৎপর হয়ে ওঠেন গ্রাম্য মোড়লরাও। তারপর এ নিয়ে ওই গ্রামের মো. জয়নাল মণ্ডলের বাড়ির উঠোনে সালিশ বৈঠক বসে। সেখানে ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা, গ্রামপ্রধান আলতাব হোসেন, মোজাম্মেল হক মন্টু, জুয়েল রানা, শফিকুল, বুলু ও আজিজুল হকসহ শতাধিক গ্রামবাসী উপস্থিত ছিলেন। সেই সালিশে নানামুখী আলোচনা শেষে দুই নারীর চরিত্রের ত্রুটি আছে এমন অভিযোগ এনে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পাশাপাশি তাদের দু’জনকে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানার ঘোষণা দেয়া হয়।

গ্রাম্য মোড়লদের এমন সালিশি সিদ্ধান্তে দিশেহারা হয়ে পড়েন দরিদ্র ওই নারীরা। তারা এই জরিমানার টাকা দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন।

জরিমানা না দিয়ে গ্রামপ্রধানদের অপমান করা হয়েছে- এমন অভিযোগ এনে ১৬ সেপ্টেম্বর পুনরায় একই স্থানে গ্রাম্য সালিশ বৈঠক বসে। সেখানে জরিমানার টাকা পরিশোধ না করায় অভিযুক্ত দুই নারীর পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়া হয়।

একইসঙ্গে গ্রামবাসী কারও সঙ্গে তাদের কথা বলা, মেলামেশা এবং কারও বাড়ি দিয়ে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি সমাজচ্যুত দুই নারীর একজন যাতে নিজের মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে না পারেন সে জন্য সালিশের দিন থেকেই পাহারাদার নিয়োগ করেছেন গ্রাম্যপ্রধানরা। এরপর থেকে ওই দুই নারী পরিবারসহ সমাজচ্যুত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এদিকে দ্বিতীয় দফা সালিশের পর অভিযুক্ত নারীদের একজন জরিমানার ২০ হাজার টাকার মধ্যে ১০ হাজার টাকা গ্রামপ্রধানদের হাতে তুলে দিয়ে তাকে মাফ করে দিতে বলেন। এতে ‘সন্তুষ্ট’ হয়ে গ্রামপ্রধানরা ওই নারীর বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির ‘আদেশ’ কিছুটা শিথিল করেছেন।

আর অপর নারী জরিমানার টাকা দিতে না পারায় তার ওপর সমাজচ্যুতি নির্দেশ বহাল রাখা হয়েছে।

বেলী খাতুন বলেন, ‘সমাজচ্যুত হওয়ার পর থেকে আমি ও পরিবারের সদস্যরা বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনো কাজে যেতে পারছি না। এমনকি স্বজনের বাড়িতেও যেতে দেয়া হচ্ছে না। মাতব্বরদের ভয়ে গ্রামবাসী কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। এমনকি আমার নিজের মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে পারছি না। এই কষ্ট কইবার মতো কোনো মানুষও নেই।’

এ বিষয়ে গ্রামপ্রধান ও ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘গ্রামের কিছু নিয়মকানুন থাকে। সেটা না মানায় তাদেরকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তাদের একজন ক্ষমা চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশ শিথিল করা হয়েছে। অপর নারী গ্রামপ্রধানদের কাছে এসে ক্ষমা চাইলে তার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির নির্দেশও শিথিল করা হবে।’

তবে ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা ও গ্রামপ্রধান বুলুর সঙ্গে পূর্বশত্রুতার জের ধরে এ‌ই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ওই দুই নারী। তাদের একজন দুই বছর আগে গ্রামপ্রধান বুলুর ভাইয়ের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। আর অপরজন ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফার কথামতো মূর্তির ব্যবসায় রাজি না হওয়ায় ষড়যন্ত্র করে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে তালম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল খালেক বলেন, ‘ঘটনাটি নিন্দ্যনীয়। বিষয়টি মিমাংসার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

তাড়াশ থানার ওসি মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর ঘটনাস্থলে থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) নূরে আলমকে পাঠানো হয়েছে। আর সমাজচ্যুতির বিষয়টি মিমাংসার জন্য গ্রামপ্রধানদের বলা হয়েছে। তারা সতর্ক না হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোহেল রানা বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পর ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যকে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করতে বলে দিয়েছি।’