সুন্দরবনে নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী গাছ

হংসরাজ নদের ভাঙনে ক্রমশ বিলীন হচ্ছে সুন্দরবনের গাছ। ১০ সেপ্টেম্বর তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

ইমতিয়াজ উদ্দীন, কয়রা: সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত একাধিক নদীর তীব্র ভাঙনে দিনের পর দিন বিলীন হচ্ছে নদীপাড়ের বনের অংশ। ভাঙনে বড় বড় কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরীসহ বিভিন্ন গাছ প্রথমে মাটিসহ নদীতে দেবে যাচ্ছে। পরে জোয়ারের পানিতে গাছগুলো নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি সুন্দরবন ঘুরে খুলনা রেঞ্জের আওতাধীন শিবসা, মরজাত, আড়পাঙ্গাশিয়া, হংসরাজ নদের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এমন ভাঙনের চিত্র দেখা গেছে। আগের চেয়ে এ ভাঙনের মাত্রা বাড়ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় জেলেরা।

বন বিভাগ বলছে, প্রাকৃতিকভাবে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনে ভাঙনের এ দৃশ্য স্বাভাবিক। একদিকে ভাঙলেও অন্যদিকে বন গড়ে উঠছে। যদিও গবেষকেরা বলছেন, উজানের নদীগুলোর ক্ষীণ প্রবাহ ও সমুদ্রস্রোতের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে ভাঙা-গড়ার ব্যবধান বাড়ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনেরও প্রভাব আছে।

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে সুন্দরবনের আয়তন কমে আসার কিছু তথ্য প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫১ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস ‘সুন্দরবন জয়েন্ট ল্যান্ডস্কেপ ন্যারেটিভ-২০১৬’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের আয়তন কমছে, জলাভূমি বাড়ছে। শেষ ২৭ বছরে ৭৬ বর্গকিলোমিটার জমি কমেছে সুন্দরবনের। 

সুন্দরবনের নদীপাড়ের বড় বড় বিভিন্ন গাছ ভাঙনের কারণে দেবে গিয়ে জোয়ারের পানিতে নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। ১০ সেপ্টেম্বর মরজাত নদের পাড়ে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান ‘স্পারসো’ ২০১২ সালে তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নদীভাঙনের কারণে সুন্দরবনের বনভূমি কমে জলাভূমির পরিমাণ বেড়েছে। ম্যানগ্রোভের চিরায়ত রীতি অনুযায়ী নতুন করে বন গড়ে উঠেছে যতটুকু, তার চেয়ে ভেঙেছে বেশি। শুধু ভাঙনের কারণেই প্রতিবছর সুন্দরবনের ছয় বর্গকিলোমিটার ধ্বংস হচ্ছে।

স্পারসোর ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সালের তুলনায় ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালে বন কমেছে সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক ম্যানগ্রোভ বনের নিয়মে স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন বেড়েছে ২৯ বর্গকিলোমিটার হারে। আবার একই সময়ে হারিয়েছে ৩২ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে ১৯৯০ থেকে ২০১০ সময়কালে বনের আয়তন বেড়েছে বছরে মাত্র ছয় বর্গকিলোমিটার হারে। এ সময়ে মানচিত্র থেকে হারিয়েছে ৪২ বর্গকিলোমিটার।

১০ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন ঘুরে দেখা গেছে, নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে মরজাত নদের পশ্চিম পাড় ধরে সুন্দরবনের ভেতরে কিছু দূর পরেই ভাঙন শুরু। ভোমরখালী ও পাটাকাটা টহল ফাঁড়ি ছাড়িয়ে গেছে এই ভাঙন। ওই অংশের বড় বড় সুন্দরী, গেওয়াসহ বিভিন্ন গাছ নদ–নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া নলিয়ান ফরেস্ট স্টেশন হয়ে শিবসা নদী দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশের পর শেখেরটেক, আদাচাই টহল ফাঁড়ি এলাকায় নদীর পূর্ব পাড়েও দীর্ঘ ভাঙন দেখা যায়। আড়পাঙ্গাশিয়া, হংসরাজসহ একাধিক নদ–নদীর তীর ভাঙনের কারণে বনের গাছের গোড়া থেকে মাটি ধুয়ে শিকড় আলগা হয়ে উপড়ে পড়ছে। কিছু এলাকায় ভাঙনের কারণে বনের ভেতরে ছোট খাল ও বড় নদীর দুই পাশে নতুন চরও জেগেছে। কিন্তু সেখানে ঘাসের আধিক্য বেশি। চরের ওপর ছোট ছোট গাছ সবে জন্মাতে শুরু করেছে।

খুলনা রেঞ্জের মরজাত নদের ভাঙনে ক্রমশ বিলীন হচ্ছে সুন্দরবনের গাছ। ১০ সেপ্টেম্বর তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

মরজাত নদের পাড় গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ভাঙছে বলে জানালেন বন বিভাগের ট্রলারচালক মো. লিটন হোসেন। তিনি বলেন, সুন্দরবনের এই অংশে সুন্দরী গাছের পরিমাণ বেশি। প্রতিদিন নদে ভাটার সময় পাড়ের গাছগুলোর নিচ থেকে মাটি সরে নদীতে দেবে যাচ্ছে। আর জোয়ারে পানি বাড়লে দেবে যাওয়া বড় বড় গাছ নদে ভেসে যাচ্ছে।

তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশ করে মাছ ধরার অনুমতি দিয়েছে বন বিভাগ। এ কারণে বর্তমানে সুন্দরবনে জেলেদের উপস্থিতি বেশি। জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিবসা ও আড়পাঙ্গাশিয়া নদীর পাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে বন ভাঙছে। আগের চেয়ে এই ভাঙনের মাত্রা এখন বেশি। গত দুই বছরে নদী ভেঙে বনের প্রায় ১৫ ফুট ভেতরে ঢুকে গেছে।

সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের ভেতরে নদীভাঙন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নদীর এক পাশ ভাঙবে, অন্য পাশে চর পড়ে বন গড়ে উঠবে—এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া ভাঙনে বনের কত অংশ নদীতে বিলীন হয়েছে, সেই তথ্য নেই। বনের ভেতরে ভাঙন রক্ষার কোনো পরিকল্পনাও কখনো করা হয়নি।

সুন্দরবন গবেষক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি পানি ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি। লবণাক্ততা বাড়লে মাটির বন্ডিং কমে যায়। তখন জোয়ারের সময় সহজেই ভাঙন ধরে। এ ছাড়া নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ায় জোয়ারের সময় পানি সুন্দরবনের অনেক ভেতরে প্রবেশ করছে। দীর্ঘ সময় সুন্দরবনের ভেতরে পানি থাকায় ভাঙন আরও বাড়ছে।