পাথর-কয়লার ব্যবসায় বড়রা

মাসুদ মিলাদ, চট্টগ্রাম: দেশে বছরে ২০ লাখ টনের মতো পাথর-কয়লা আমদানি হতো বছর পাঁচেক আগেও। তখন মূলত ভারত ও ভুটান থেকেই স্থলবন্দর দিয়ে ট্রাকে করে আমদানি হতো এ দুটো পণ্য। কিন্তু দিন দিন চাহিদা তথা ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন সমুদ্রপথেও বিপুল পরিমাণে পাথর ও কয়লা আসছে। তাতে বছরে আড়াই থেকে তিন কোটি টন পাথর ও কয়লা আমদানি হচ্ছে।

আগে ছোট ছোট ব্যবসায়ী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত ও ভুটান থেকে পাথর ও কয়লা আমদানি করতেন। যখন পণ্য দুটির বাজার বড় হতে শুরু করে, তখন তা চোখ এড়ায়নি কিছু বড় শিল্পগোষ্ঠীর। গত দু-তিন বছরে তারা এই দুটো পণ্য আমদানিতে যুক্ত হয়েছে। এসব শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে মেঘনা গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ ও পারটেক্স গ্রুপ অন্যতম। সাগর ও নদীপথে নিজেদের জাহাজ ব্যবহার করে তারা বিদেশ থেকে সরাসরি পাথর ও কয়লা নিয়ে আসছে।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে পাথর আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ টন। প্রতি টন ৩ হাজার ৬০০ টাকা গড় দরে এই পাথরের স্থানীয় বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। অথচ বছর পাঁচেক আগেও এই বাজারের আকার ছিল মাত্র ৬০ কোটি টাকা।

আবার গত অর্থবছরে কয়লা আমদানি হয়েছে ৬৪ লাখ টন। দেশ ও মানভেদে গত বছর দেশের বাজারে কয়লার দাম ছিল টনপ্রতি গড়ে ৯ হাজার টাকা। বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল হওয়ায় দেশেও কয়লার দাম বেড়েছে। দাম বেড়ে এখন প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে গড়ে ১৯ হাজার টাকায়। সেই হিসাবে দেশে কয়লার বাজারের আকার বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকার। পাঁচ বছর আগেও কয়লার বাজারের আকার ছিল প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার। দেশে পাথর ও কয়লার বাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।

জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিরুল হক বলেন, মূলত যেসব শিল্পগোষ্ঠীর সিমেন্ট কারখানা রয়েছে, তারা পাথর আমদানিতে যুক্ত হচ্ছে। কারণ, রেডিমিক্স কারখানার উপাদান হিসেবে পাথর আমদানি করছে তারা। অর্থনীতির আকার যত বাড়বে, পাথর আমদানিও তত বাড়বে। তবে কয়লার ব্যবহার খুব বেশি না বাড়লেও একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি থাকবে।

দেশে চাহিদার তুলনায় কয়লা ও পাথর উত্তোলনের পরিমাণ খুবই কম। পেট্রোবাংলার অধীন দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা কোম্পানিতে উত্তোলিত পাথর দিয়ে দেশীয় চাহিদার মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ মেটানো যায়। আর দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কয়লা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ দেশীয় চাহিদা পূরণ না হওয়ায় আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে।

পাথর ও কয়লা বাজার ক্রমাগত বড় হওয়ায় বৃহৎ শিল্প গ্রুপগুলো নিজেদের ব্যবহারের পাশাপাশি পণ্য দুটির বাণিজ্যেও যুক্ত হচ্ছে। যেমন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) পণ্য দুটি আমদানি করে বিক্রি করছে। কয়েক বছর আগে নিজেদের অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের জন্য তারা পাথর আমদানি শুরু করে। এর পরে বাণিজ্যে যুক্ত হয়। এক বছর আগে থেকে কয়লা আমদানি শুরু করে তারা।

জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিক সিমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম বলেন, ‘ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনতে ও ভোক্তাদের এক জায়গা থেকে সেবা দিতে মেঘনা গ্রুপ নতুন এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। আমরা আগে থেকে সিমেন্ট, সিরামিক, স্টিলসহ বিভিন্ন ধরনের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসায় যুক্ত। এরই ধারাবাহিকতায় পাথর ও কয়লার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছি।’

পাথর

বাংলাদেশে পরিমাণের দিক থেকে যত পণ্য আমদানি হয়, তার মধ্যে গত অর্থবছরে পাথর ছিল শীর্ষে। অবকাঠামোর মান বাড়াতে ইটের খোয়ার পরিবর্তে পাথরের ব্যবহার বাড়তে থাকায় দেশে গত পাঁচ বছরে ধারাবাহিকভাবে এই পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। বড় প্রকল্পে পাথর ব্যবহারের চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গতি এনেছে।

প্রথম দিকে ছোট ছোট ব্যবসায়ী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত ও ভুটান থেকে পাথর আমদানি করতেন। তখন বোল্ডার আকারে দেশে এনে কারখানায় চূর্ণ করে তারপর বিক্রি করা হতো। কিন্তু স্থলবন্দর দিয়ে পাথর এনে চাহিদা পূরণ না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। সে সময় প্রকল্পের ঠিকাদারেরা আমদানি করতেন।

পাথরের বাজারের আকার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর যুক্ত হতে শুরু করে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো। বসুন্ধরা গ্রুপ তিন বছর আগে পাথর আমদানি শুরু করে। এরপর মেঘনা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ ও আবুল খায়ের গ্রুপ যুক্ত হয় পাথর আমদানিতে। মূলত বন্দরে বড় জাহাজে পাথর আনার পর সেখানেই, অর্থাৎ সরাসরি বড় জাহাজ থেকেই পাথর বিক্রি শুরু হয়। এ ছাড়া ডিলারদের মাধ্যমেও বিক্রি করছে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো।

কয়লা

বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া কয়লার ব্যবহার হয় মূলত ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে। এ ছাড়া চা-বাগান, শিল্পকারখানার বয়লার ও রেস্তোরাঁয় সামান্য পরিমাণে কয়লা ব্যবহৃত হয়। কাঠের পরিবর্তে কয়লা ব্যবহার করে ইট পোড়ানো বাড়তে থাকায় কয়লা আমদানি বাড়ছে।

কয়লা আমদানিতে শুরুর দিকে ছিল পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠান পারটেক্স কোল লিমিটেড। এই তালিকায় পরে যুক্ত হয় বসুন্ধরা গ্রুপ। এখন মেঘনা গ্রুপও কয়লা আমদানি করে বিক্রি করছে।

বিশ্ববাজারে কয়লার দাম হু হু করে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোট আমদানিকারকেরা কয়লা আমদানিতে পিছিয়ে পড়ে। দামের এই অস্থিরতার সময়ে বড় গ্রুপগুলো আমদানি বাড়িয়েছে। গত মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৪ মাসে গড়ে ৬৪ হাজার টন করে কয়লা আমদানি হয়েছে। বড় গ্রুপগুলো আমদানি বাড়িয়ে দেওয়ায় এখন গড়ে প্রতি মাসে সাড়ে পাঁচ লাখ টন করে কয়লা আমদানি হচ্ছে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইএমআর মেটালার্জিক্যাল রিসোর্সেস কোম্পানির বাংলাদেশের ব্যবসা উন্নয়ন ব্যবস্থাপক ইফতেখার আহমেদ  বলেন, আমদানি বাড়তে থাকায় বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো গত এক-দুই বছরে কয়লা আমদানিতে যুক্ত হয়েছে। কয়লার বৈশ্বিক বাজার অস্থিতিশীল হলেও গত তিন মাসে এ দেশে আমদানি বেড়েছে মূলত বড় শিল্পগোষ্ঠীর হাত ধরে।

আমদানি তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও রেডিমিক্স কারখানাগুলো শুরুতে আমদানির শীর্ষে থাকলেও ধীরে ধীরে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ছে। নিজেদের সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে শুরু করে ছোট জাহাজ ও পণ্য পরিবহনের গাড়ি ও সরবরাহব্যবস্থা মজবুত থাকায় খুব সহজেই কয়লা ও পাথরের বাণিজ্যে যুক্ত হচ্ছে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলো।