{getBlock} $results={3} $label={ছবি} $type={headermagazine}

সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পিছিয়ে বাংলাদেশ, ভারত-পাকিস্তান-মিয়ানমার সফল

প্রকাশঃ
অ+ অ-

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ফাইল ছবি

চীনের সঙ্গে যৌথ সমীক্ষায় পাকিস্তান সম্প্রতি আরব সাগরের তলদেশে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস খুঁজে পেয়েছে। এখনো ঠিক কতটুকু রয়েছে তা জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গ্যাস উত্তোলন শুরু হলে পাকিস্তানের অর্থনীতি অনেকটা বদলে যেতে পারে। দেশটি গ্যাস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে। তাই সরকার আরও বড় পরিসরে অনুসন্ধান কার্যক্রমে বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানিয়েছে। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ সংস্থা এসএফসি প্রকল্পে অংশগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

এর আগে, গত বছরের জানুয়ারিতে ভারতও গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কার করেছিল। অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে ওএনজিসি কোম্পানি তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনা দেখিয়েছে। সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, খনিটি চালু হলে প্রতিদিন ৪৫ হাজার ব্যারেল তেল এবং ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হবে। এতে ভারতের তেল উৎপাদনের ১১ শতাংশ এবং গ্যাস উৎপাদনের ১৫ শতাংশ পূরণ করা যাবে। বছরে দেশের জ্বালানি খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি রুপির সাশ্রয় হবে।

বাংলাদেশের নিকটবর্তী বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারও বড় পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কার করেছে। মিয়া ও শোয়ে কূপ থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হয়েছে। মিয়ানমার নিজ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এই গ্যাস চীনেও রফতানি করছে।

তবে বাংলাদেশ সমুদ্রসীমায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি। সমুদ্রসীমা চূড়ান্ত হওয়ার পর এক দশকেরও বেশি সময় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গত বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো বিদেশী প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রসীমা চূড়ান্ত হওয়ার পর মিয়ানমার ও ভারত গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। তারা বিদেশী কোম্পানিকে নিজেদের জলসীমায় টানতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সময়ক্ষেপণ এবং আমদানিনির্ভর নীতির কারণে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডাকা আন্তর্জাতিক দরপত্র অন্তর্বর্তী সরকারের সময় উন্মুক্ত হলেও কোনো প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়নি। ফলে দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র অঞ্চলে সম্ভাব্য জ্বালানি সম্পদ এখনও অজানা থেকে গেছে।

ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, 'সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর মিয়ানমার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করেছে, ভারত গভীর সমুদ্রে তেল পাচ্ছে। বাংলাদেশের জলসীমাতেও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হলে আমরা প্রস্তুত থাকতে পারি না। আর যখন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, তারা অন্য দেশে বিনিয়োগ করে ফেলছে।' 

তিনি আরও যোগ করেন, 'বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকারের পরিকল্পিত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কেন গত বছরের দরপত্রে কোনো কোম্পানি অংশ নেয়নি, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।' 

বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মোট ২৬টি ক্ষেত্র রয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি গভীর এবং ১১টি অগভীর সমুদ্রে। কিছু অঞ্চলে বিদেশী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, কিন্তু পরে তারা সরে গেছে। সর্বশেষ অগভীর সমুদ্রের অঞ্চল এসএস-০৪ ও এসএস-০৯-এ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি ভিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড কাজ করছিল। কিন্তু এক দশকেরও বেশি সময় পরও ফলাফল সন্তোষজনক হয়নি। সম্প্রতি পেট্রোবাংলা এই দুই প্রতিষ্ঠানের কাজের নিশ্চয়তা (ব্যাংক গ্যারান্টি) প্রত্যাহার করেছে। ফলে এখন সমুদ্রজ্বালানি অনুসন্ধানে কোনো প্রতিষ্ঠান সক্রিয় নেই।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো—ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই ও থাইল্যান্ড—তাদের তেল ও গ্যাস খাতের দরপত্রে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সুবিধা স্পষ্টভাবে দেখায়। ফলে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস সংস্থাগুলো (আইওসিগুলো) এখন সেসব অঞ্চলে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

ইন্দোনেশিয়া চলতি মাসে পূর্ব জাভার পেরকাসা তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে। দক্ষিণ সুমাত্রার গ্যাঘাও ক্ষেত্রেও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। ব্রুনাই সরকার এপ্রিলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নতুন সংস্থা আনার ক্ষমতা দেখিয়েছে। থাইল্যান্ডে অফশোরের নয়টি এলাকায় দরপত্রে ২৫টি সংস্থা অংশ নিয়েছে। ভিয়েতনাম বিভিন্ন ধরনের কোম্পানিকে সরবরাহকারী হিসেবে নিয়েছে। মালয়েশিয়ার গভীর সমুদ্রে দুটি দরপত্রে ব্যাপক সাড়া এসেছে। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পেট্রোনাস আশা করছে চলতি বছরে এসব দরপত্রের মাধ্যমে বিদেশী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করতে পারবে। চীনও তাদের তেলক্ষেত্র ও রিফাইনারিতে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে।

এই সময় দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় বিদেশী সংস্থাগুলো ব্যাপক আগ্রহ দেখালেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। গত বছর আন্তর্জাতিক দরপত্রে কোনো সংস্থা অংশ না নেওয়ায় সরকার এখন দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব বলেন, 'সাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ডাকা দরপত্রে কোনো সংস্থা কেন অংশ নেয়নি, তা খতিয়ে দেখে জ্বালানি বিভাগের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। সমস্যাগুলো স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই ও মতামত নিলে আমরা দরপত্রে যাব। আশা করি এ বছরের মধ্যে নতুন দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব হবে।' 

জানা গেছে, জ্বালানি বিভাগ পুনরায় দরপত্র আহ্বানের কাজ শুরু করেছে। বিশেষ করে বিদেশী সংস্থাগুলো সমুদ্রে জরিপের তথ্য কিনলেও কেন দরপত্রে অংশ নেয়নি, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু সমস্যার তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব সমস্যা সমাধান ও সংশোধনের পর পুনরায় দরপত্রে যাবে সরকার।

জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, 'অফশোরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তারা তেল ও গ্যাস উত্তোলনের লাভের ভাগ, জরিপের তথ্যের অভাব এবং কর্মীদের লাভের তহবিল ভাগাভাগি নিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। এগুলো কতটা সংশোধন সম্ভব, তা নিয়ে কাজ চলছে। দ্রুত এসব সম্পন্ন করে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হবে।' 

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের মার্চে বঙ্গোপসাগরে ডাকা শেষ দরপত্রে শুরুতে সাতটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান নথি কিনেছিল। প্রতিযোগিতা বাড়াতে সময় তিন মাস বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়নি।

বাংলাদেশে সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান মূলত ২০০৮ সালে শুরু হয়। পিএসসি চুক্তির আওতায় ২০১০ সালে মার্কিন প্রতিষ্ঠান কনোকোফিলিপস গভীর সমুদ্রে দুটি এলাকায় কাজ করে দ্বিমাত্রিক জরিপ চালায়। কিন্তু গ্যাসের দাম বৃদ্ধির দাবি পূরণ না হওয়ায় ২০১৫ সালে তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়। এরপর পিএসসি-২০১২-এর অধীনে ২০১৪ সালে অগভীর সমুদ্রে দুটি এলাকায় ভারতের ওএনজিসি ভিদেশ চুক্তি করে। অন্য দুটি এলাকায় চুক্তি হয় অস্ট্রেলিয়ার স্যান্তোস ও সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জির যৌথ সংস্থার সঙ্গে। ২০২০ সালে স্যান্তোস ব্যবসা বন্ধ করে চলে যায়।

দরপত্র ছাড়াই ২০১৬ সালে সমুদ্রে দুটি ব্লকে চুক্তি হয় দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ুর সঙ্গে। তবে তারা নির্ধারিত সময়ের আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

এরপর এক দশকের বেশি সময় দেশে সমুদ্রের অঞ্চলে কোনো বিদেশী সংস্থা কাজ পাননি। গ্যাস সংকট শুরু হলে বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকার জ্বালানি পণ্য আমদানি করা হয়েছে। সহজ উপায়ে এলএনজি কেনার কারণে দেশের সমুদ্র অংশে মনোযোগ কম ছিল। দীর্ঘ সময়ের স্থবিরতা বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, 'বাংলাদেশে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা খুব কম। বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে দীর্ঘদিন অনীহা দেখা দিয়েছে। এটি দ্রুত কাটিয়ে ওঠা জরুরি।' 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন